মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ দেখে তখন যারা গন্ধে নাক ধরে রাখত, একটু সহযোগিতা চাইলে দূরে সরে যেত, তারাই এখন বড় মুক্তিযোদ্ধা। তাদেরই সার্টিফিকেট আছে, নাম আছে, সুবিধা আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার সীমান্তবর্তী কুল্লাপাথরে টিলার ওপর সারি সারি মুক্তিযোদ্ধার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে খেদ প্রকাশ করছিলেন আবু তাহের ও মর্তুজা আলী।
তাদের কথায় ফুটে ওঠে কতটা ঝুঁকি নিয়ে, জীবন-মরণের তোয়াক্কা না করে মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাসই তারা কিভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দিয়েছেন। মরদেহগুলোকে রক্ষা করেছেন শিয়াল-কুকুরের মুখ থেকে।
এই বিশেষ কাজটিতে তারা ছিলেন পাঁচজন। আবু তাহেরের বাড়ি কুল্লাপাথর গ্রামে, মর্তুজা আলীর কাশীরামপুর। আর ছিলেন কুল্লাপাথরের আনু মিয়া ও গেদু মিয়া এবং বায়েকের রশিদ।

আর পুরো কাজের মূল তদারকিতে ছিলেন কুল্লাপাথরের আবদুল করিম। করিমের বাবা আবদুল মান্নানই ছিলেন এই পাহাড়ি টিলার মালিক। তাদের পারিবারিক গোরস্থানই সেসময় হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই কুল্লাপাথরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢুকতে পারেনি। তবে অদূরেই সালদা নদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের সম্মুখসমর হয়েছে। তাতে দুই পক্ষেই অনেক প্রাণহানিও ঘটেছে।
কুল্লাপাথরে ঢুকতে না পারলেও হানাদাররা দূরের ঘাঁটি থেকে আর্টিলারি শেল ছুড়ত। তাতেই প্রাণহানি ঘটত এখানকার সাধারণ মানুষের। একবার একটি শেলে ৫টি গরুরও মৃত্যু হয়।
সেই স্মৃতিই আওড়াচ্ছিলেন আবু তাহের ও মর্তুজা। তবে তাদের সবচেয়ে ভয়াবহ একটি দিনও ছিল—যেদিন দুজনই প্রায় মরতে বসেছিলেন।
আবু তাহের বলেন, তখন বিকেল। আমরা এই কুল্লাপাথরের টিলায় কবর খুঁড়তাছি। অর্ধেক খোঁড়াও হইয়া গেছে। এর মধ্যেই হঠাৎ পু-উ-উ-উ… শব্দে পাকিস্তানিদের ছোড়া একটি আর্টিলারি শেল মাথার উপর দিয়া গিয়া পড়ল খানিক দূরে। আমরা তখন ছিলাম দু’জন। কবর খুঁড়তে খুঁড়তে সেই কবরের মধ্যিই শুইয়া পড়লাম। নিচে তখন গোসল করানো হচ্ছিল মরদেহ। পরে সেই কবর খোঁড়া শেষ করে কবর দিছি।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন দেওয়ার এই মহান কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখলেও নেই স্বীকৃতি। অথচ যুদ্ধের নয়টি মাস তারা এই টিলার চূড়ায় নিজেদের জীবনের মায়া না করে একে একে কবর দিয়েছেন ৫০ শহীদকে।
কেবল যে দাফন করেছেন তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাথায় করে বয়ে নিয়ে গেছেন গোলা বারুদ। যোগাড় করেছেন কিংবা পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য খাবার।
নিজেদের কখনও মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেননি। এতে মনে কোনও কষ্টও নেই। কৃষিকাজ করে কোনও রকম বেঁচে আছেন, আবু তাহের ও মর্তুজা।

দু’জনই একসুরে বললেন, আমাগো কোনও কষ্ট নাই। আমরা তো দেশের জন্যিই কাম করছি। বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করছি। সেই সময় অন্য কিছু ভাবি নাই। শুধু ভাবছি দেশ স্বাধীন করতে হইব। অস্ত্র দিয়া যুদ্ধ করি নাই। কিন্তু রাত বিরাতে তিন চার কিলোমিটার পথ গোলাবারুদ মাথায় নিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাই দিছি। খুব কষ্ট হইত। অনেক ওজন। একবার মাথা থেইক্যা নামাইতাম আবার তুলতাম। তবে দিন শেষে শান্তিই লাগত।
দাফন করা প্রসঙ্গে তারা আরও বলছিলেন, আশপাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ সংগ্রহ করে এখানে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন কুল্লাপাথরের আব্দুল মান্নান ও তার স্ত্রী-সন্তান। এই জায়গাও তিনিই সরকারকে দিয়েছেন। মান্নান সাহেবের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম এখন দেখাশোনা করেন। তখন বারবার কাফনের কাপড় কেনা সমস্যা বলে একেবারের অনেকটা কাপড় কিনে রাখতেন তিনি। জানাজা পড়ানোর দায়িত্বও তিনি নিতেন।
বলছিলেন, জানাজা পড়ানোর সময়ও অনেক দিন আর্টিলারি শেল পড়েছে আশপাশে। প্রথম কবরটি তারা দিয়েছিলেন আগরতলায় শহীদ হওয়া হাবিলদার তৈয়ব আলীর। আব্দুল করিমই কুল্লাপাথরে মরদেহ দাফনের প্রস্তাব দেন। মুক্তাঞ্চল ও শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল হওয়ায় সেই জানাজায় প্রচুর সংখ্যক মানুষ হয়েছিল।
তৈয়ব আলী বলেন, একেক দিন মাথার খুলি, হাত-পা উড়ে যাওয়া বীভৎস মরদেহও আসত। মাঝে-মধ্যে ভয়ও লাগত। কিন্তু তারপরও দেশের জন্য কাজ করতাছি মনে করে সবই করছি।
তিনি বলেন, ‘বড় বড় শিয়াল আসত, সেই শিয়ালের মুখ থেকে আমরা শহীদদের লাশ রক্ষা কইরা কবর দিছি। ’
আপনারা যেটা করেছেন সেটাও তো অনেক বড় যুদ্ধ। কিন্তু আপনারা তো মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পাননি। এটা নিয়ে খারাপ লাগে না? একটু কষ্টমাখা মুচকি হেসে তাদের উত্তর, খারাপ লাগব ক্যান। আমরা তো জানি আমরা এই কাজগুলান করছি। সাক্ষীও আছে। স্বীকৃতি না দিয়ে কী করুম। আমরা কাউরে কিছু বলিও না। কষ্টে কোনও রকম দিন তো যাইতেছে। দেশের জন্যি কিছু করার সুযোগ পাইছি এইডাই আমাগো শান্তি।
‘সেই সময় লাশের গন্ধ দেইখা যারা নাক ধইরা রাখত, তারাই আজ বড় মুক্তিযোদ্ধা’—খেদ ঝরে তৈয়বের মুখে।
তবে গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করছে বলেই জানান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ গ্রামটি ছিল মুক্তাঞ্চল। আখাউড়া রেলস্টেশন থেকে দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। নয় মাসে কখনও এই গ্রামে পাকিস্তানিরা ঢুকতে পারেনি। তাই শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল এ স্থানটি। বেশ দূর থেকে আর্টিলারি শেলের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে আশপাশের শত শত মুক্তিযোদ্ধা। যাদের সবাইকে চিহ্নিত বা সমহিত করা যায়নি। তবে যাদের শনাক্ত করে সমাহিত করা হয়েছিল তাদের আত্মীয়-পরিজন এসে এখনও আব্দুল করিম, তৈয়ব, মর্তুজাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০২২ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৫
** কুল্লাপাথরের যে টিলায় শায়িত ৫০ যোদ্ধা