‘চোখের সামনে পাকিস্তানি হানাদাররা নারীদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে দেওয়া আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে।
প্রশ্নগুলো শহীদ জায়া জেসমিন আলমের। তার স্বামী শহীদ মুরিদুল আলম। একাত্তরের ২০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কেশুয়া গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাঁশখালীর উদ্দেশ্যে বের হন। পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর ভোরে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পুঁইছড়ি জলকদর খালের পাড়ে রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তিনি।
মঙ্গলবার রাতে নগরীর আবেদীন কলোনির বাসভবনে বসে শহীদ জায়া জেসমিন আলম ‘বাংলানিউজ’কে বলেন, ‘একাত্তরের নয়টি মাস ঘোরের মধ্যে কেটেছে। কী যে কষ্ট গেছে বলে বোঝাতে পারব না। স্বামী থাকতেন রণাঙ্গনে। পেটে বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে আমাকে। কখনও আত্মীয়ের বাড়ি। কখনও বাবার বাড়িতে। কখনও শ্বশুর বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে নৌকায় শঙ্খ নদী পাড়ি দিয়ে মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ’
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুরিদুল আলম ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞাসে মাস্টার্স করেন। এর আগে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ মুরিদুল আলম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন।
স্বামীর স্মৃতিচারণ করে জেসমিন আলম বলেন, ‘একাত্তরে রাতের বেলা কখনও বাড়িতে থাকতেন না মুরিদুল। দিনের বেলা লুকিয়ে কিংবা ছদ্মবেশে বাড়িতে আসতেন। একদিন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের একটি চিঠি এলো। বাঁশখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। সেটি মীমাংসা করতে বাঁশখালী যেতে হবে। ২০ সেপ্টেম্বর আমার শ্বশুর এবং শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় দিনের বেলা বাড়িতে ছিলেন মুরিদুল। গভীর রাতে নৌকাযোগে বাঁশখালী রওনা হন তিনি। আমার শাশুড়ি তাকে যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু সে বেরিয়ে যায়। আমার বড় ছেলের বয়স ছিল তখন দেড় বছর। ভোরের দিকে ঘুমের ঘোরে বাবা-বাবা বলে ডেকে উঠছিল। আমার শ্বশুরও জ্বরের ঘোরে মুরিদুলকে নিয়ে বিভিন্ন প্রলাপ বকতে লাগলেন। তখন আমার মনে অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধতে লাগল। এর একদিন পর খবর পেলাম মুরিদুল আর নেই। ’

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের পর তার হাড়গোড় উদ্ধার করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসে কবর দেয়া হয়। তার হাড়গোড়ের সঙ্গে হাত ঘড়ি ও চশমাটি পাওয়া গেছে। ’
জেসমিন আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতারা মুরিদুলকে ভারত চলে যেতে বলেছিলেন। ভারত চলে যেতে শেখ ফজলুল হক মনি চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে যেতে রাজি হননি। ’
আক্ষেপ করে এ শহীদ জায়া বলেন, ‘যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুরিদুল যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন কি আদৌ হয়েছে? আজকের এ বাংলাদেশ কি চেয়েছিলেন তিনি? তার স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হলেই কেবল তার আত্মা শান্তি পাবে। ’
শহীদ মুরিদুলের বড় ছেলে মাহবুবুর রহমান শিবলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছোটবেলায় বন্ধুরা যখন বাবার হাত ধরে স্কুলে যেত তখন আক্ষেপ ছিল। আমার বাবা নেই। কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন বুঝতে শুরু করলাম আমার বাবা একজন মেধাবী ছাত্রনেতা ছিলেন। তখন গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। শহীদ মুরিদুল আলমের সন্তান জেনে দলমত নির্বিশেষে সবাই যখন কাছে টেনে নেন তখন নিজেকে আর অসহায় মনে হয় না। তখন মনে হয় দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধা আমার বাবা। ’
‘যখন শুনি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নামার পর বাবাকে না দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মুরিদুল কোথায়?” আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, “যুদ্ধে আমরা তাকে হারিয়েছি। ” বঙ্গবন্ধু রুমালে চোখ মুছে বলেছিলেন, “আমি আমার এক মেধাবী সহচরকে হারিয়েছি। ” তখন একজন শহীদের সন্তান হিসেবে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে হয়’—বলেন মাহবুব।
ছোট ছেলে মাহবুবুর রহমান চিশতি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী। মুরিদুল আলম শহীদ হওয়ার ৩১ দিন পর তার জন্ম। বাবার স্নেহ বা মমতা কোনওটাই পাননি তিনি। বাবা কী জিনিস সেটিও বুঝতে পারেননি কখনও। কিন্তু বড় হয়েছেন বাবার দুঃসাহসিক জীবনের গল্প শুনে। বললেন, ‘বাবাকে বাবা ডাকতে না পারার হাহাকার বুকে থাকলেও আমার পরিচয় আমি একজন শহীদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এটাই আমার গর্ব। ’

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫