শহীদ কুরবান আলী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সিলেটে যে কজন বীর সেনানী পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছেন।
একাত্তরের এপ্রিল মাস। চারিদিকে একের পর এক পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা চলছে। আহত হয়ে শত শত মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। সে সময় মানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন সিলেটের হাতেগোনা কয়েকজন চিকিৎসক-কর্মচারী।
জীবনের মোহ ত্যাগ করে তারা মানবসেবায় রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় অবদান। প্রাণ সংহারের ভয় যাদের কর্তব্য থেকে পিঁছু হঠাতে পানেনি—তাদেরই একজন শহীদ কুরবান আলী।
দেশ স্বাধীনের ৪৩ বছর পেরুলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের স্বীকৃতি পাননি এই বীর সেনানী। বাবার জন্য আজও কেঁদে বুক ভাসান শহীদ কুরবান আলীর সন্তানেরা। তাদের একটিই আক্ষেপ—‘সরকারি সুযোগ-সুবিধা নাই বা পেলাম, মৃত্যুর আগে হলেও দেখে যেতে চাই বাবাকে শহীদের স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র। ’ বাংলানিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাতে এমনই আক্ষেপের বর্ণনা দেন তাঁর মেয়েরা।
শহীদ কুরবান আলী দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী আফতেরা বেগম এবং দ্বিতীয় স্ত্রী আছিয়া খাতুন। তারাও বেঁচে নেই। রয়েছেন তাদের সন্তানেরা।
আফতেরা বেগমের ঘরে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা হচ্ছেন—তমিজুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম এবং মেয়ে সমিরুন নেছা। তারা সকলেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় স্ত্রী আছিয়া বেগমের ঘরে তিন মেয়ে ও এক ছেলে। এদের মধ্যে বড় মেয়ে ছবি বেগমের বয়স ষাটের কোটায়। পঞ্চাশ পেরিয়ে বার্ধকের কোটায় মেঝমেয়ে তসলিমা বিবি, ছোট মেয়ে ফেরদৌসীর বয়স ৪৫ বছর। আর এক ছেলে আবুল বশর মাত্র ২৫ বছর বয়সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাইস্থ রায়হোসেন আবাসিক এলাকার রংধনু-৬৪/১ নং বাসায় বাংলানিউজ প্রতিনিধির সাথে কথা হয় শহীদ কুরবান আলীর মেঝো মেয়ে তসলিমা বিবির। বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেঝমেয়ে তসলিমা বিবি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। আমার বয়স তখন সাত। আমরা বাবার সাথে সিলেট সদর হাসপাতালে সরকারি কোয়ার্টারে ছিলাম।
২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়। চারদিন বাবার খোঁজ মেলেনি। চারিদিকে বোমা ও গুলির শব্দে আমরা ভাই-বোন আতঙ্কে কাঁদতাম। ২৯ মার্চ বাসায় ফিরলেন বাবা। রক্তে ভেজা তাঁর পরনের কাপড়।
আমরা কান্নাকাটি করায় ওই রাতে বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার জোড়াপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তবে বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। পথিমধ্যে সিলেটের দয়ামীর বাজারের থানাগাঁওয়ে নানা বাড়িতে রেখে আসেন আমাদের।
বাবা চলে আসার সময় আমরা সকলে কান্না জুড়ে দেই। বাবাকে বলি, ‘তুমি যেও না, আমাদের সঙ্গে বাড়ি চলো। বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মা রে, তোমরা যাও, আমি যুদ্ধ শেষে চলে আসব। ” সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না বাবা। যখনই বাবার কথা মনে পড়ে তখন সংগৃহীত একটি ছবি বুকে জড়িয়ে ধরি। এই বুঝি আদর করছেন বাবা। ’
কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখের আড়ালে লুকানো অশ্রু অলক্ষ্যে বেরিয়ে আসে তসলিমার। তিনি বলেন, ‘বিট্রিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন বাবা। দিন-তারিখ মনে নেই, তবে দেশে ফেরার পর সিলেট সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে যোগ দেন।
তসলিমা বেগম বলেন, মায়ের কাছ থেকে জেনেছি—২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরুর পরপরই বাবা সিলেট সদরের ৪নং সেক্টরের সাবসেক্টর বারপুঞ্জি চলে যান। কমান্ডার মেজর সিআর দত্ত ও ক্যাপ্টেন রবের অধীনে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। পাশাপাশি জীবন বাজি রেখে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে অ্যাম্বুলেন্সে করে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসতেন তিনি।
সে সময়ে সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের হাতে হাত মিলিয়ে আহত মানুষের সেবা করে গেছেন তিনি। অ্যাম্বুলেন্স চালক হয়েও অপারেশন থিয়েটারে সহযোগিতা করেছেন চিকিৎসকদের। নার্সের হাতে হাত মিলিয়ে সেবা দিয়ে গেছেন আহতদের।
আহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করতে ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল সিলেট সদর হাসপাতালে আক্রমণ করে পাক হানাদার বাহিনী। এইদিনে শহীদ কুরবান আলীসহ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন, ডা. শ্যামলকান্তি লালা, মেইল নার্স মাহমুদুর রহমান ও আরও সাত-আটজনকে গুলি করে হত্যা করে তারা। ’
তসলিমা বেগম বাংলানিউজকে জানান, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও ভাতা পাওয়ার জন্য তারা বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন বিভিন্ন দফতরে। কিন্তু ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। এখনও বাবার মৃত্যু দিবসের সময় তিনি নিজ উদ্যোগে দোয়া করান।
নগরীর চৌহাট্টা সড়কের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সেদিনের শহীদ বীর সেনানীরা। যেখানে তাদের হত্যা করা হয়, সেখানে গড়ে ওঠে এই বীর সেনানীদের স্মরণে শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভ। সাক্ষী হিসেবে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মিনার।
কিন্তু এই বীর সেনানীদের আজও সরকারিভাবে সিলেটে স্মরণ করা হয় না। তাদের কেউই পাননি মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক।
এ দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। প্রতি বছর ৯ এপ্রিল এই শহীদদের ফুলের শ্রদ্ধা জানায় সংগঠনগুলো।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট কমান্ডের সহকারি কমান্ডার (ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ) আতিকুর রহমান চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজন সেজেও অনেকে সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃত শহীদ বীর সেনানী কুরবান আলীর সন্তানরা আজও বঞ্চিত। দুর্ভোগের মধ্যে দিনতিপাত করছেন তারা।
তিনি বলেন, ২০০৩ সালে জীবিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সদস্যদের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডে চিঠি আসে যুক্তরাজ্য থেকে। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় বিট্রিশ সেনাবাহিনী প্রদত্ত সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন কুরবান আলীর সন্তানরা।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট কমান্ডের সভাপতি সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, ‘কুরবান আলী স্বাধীনতার যুদ্ধে একজন শহীদ বীর সেনানী। এতে কোনও সন্দেহ নেই। পাকিস্তানীদের প্রতিরোধের পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। ’
তিনি বলেন, পাকহানাদার বাহিনী টার্গেট করেই সদর হাসপাতাল থেকে তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। প্রতিবছর শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হলেও এই বীর সেনানীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সন্তানদের ভাতা পাইয়ে দিতে আমরাও চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫,২০১৫