মূল নকশার কথা মাথায় রাখলে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে অসম্পূর্ণই বলতে হবে। স্বাধীনতার অনবদ্য স্মারক স্মৃতিসৌধের বর্তমান যে চিত্র তার অনেক কিছুই ছিল না মূল নকশায়।
মূল নকশার সাথে স্মৃতিস্তম্ভের কেবল অসম্পূর্ণতাই নয়, জীবদ্দশায় যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন পাননি গুণী এই স্থপতি। এই আক্ষেপ মাইনুল হোসেনের পরিবারকে এখনও পোড়ায়। স্মৃতিসৌধের উদ্বোধনী দিনেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি একুশে পদকপ্রাপ্ত এই প্রতিভাবান স্থপতিকে।
বাংলানিউজের সঙ্গে একান্তে আলাপচারিতায় এমনটিই বললেন প্রয়াত মাইনুল হোসেনের স্ত্রী আসমা আকতার।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সাভারে নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের। ১৯৭৮ সালে নকশা আহ্বান করা হলে জমা পড়ে ৫৭টি নকশা।
এর মধ্যে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ের স্মারক জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্মৃতির মিনারের জন্য নির্বাচিত হয়—সে সময়ে ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি মাইনুল হোসেনের নকশাটি।
তার নকশা অনুযায়ী বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন পর্যন্ত ছিল সাতের প্রভাব। যার প্রমাণ স্মৃতিসৌধের বেদীমূল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সাতটি ত্রিকোণ কলাম। সবচেয়ে বড়টি ১৫০ ফুট উঁচু। এই সাতটি কলামে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে। আকার আকৃতিতে ভিন্নতা থাকায় একেক দিক থেকে স্মৃতিসৌধকে দেখায় একেক রকম।
দীর্ঘ ২২ বছরের কর্মজীবনে সৈয়দ মাইনুল হোসেন ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন, চট্টগ্রাম ইপিজেড কার্যালয়, জাতীয় যাদুঘর ও উত্তরা মডেল টাউনের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নকশার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন।

১৯৫২ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় জন্ম নেওয়া সৈয়দ মাইনুল হোসেনের জীবনাবসান ঘটে ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর। দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নকশা তৈরির স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৮ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন এই স্থপতি। তবে বঞ্চনার যাতনাও কম সইতে হয়নি তাকে। যেমনটি বলছিলেন সৈয়দ মাইনুল হোসেনের ছোট মেয়ে সৈয়দা তানজিনা হোসেন।
বাংলানিউজকে তিনি তার খেদ ও বেদনার কথা বলছিলেন এভাবে, ‘জীবদ্দশায় বাবাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। বাবা এখন নেই। এখন এসব বলেই বা কী লাভ! ২০০৫ সাল পর্যন্ত স্মৃতিসৌধের নামফলকে বাবার নামের বানান ভুল ছিল। বাবার নাম সৈয়দ মাইনুল হোসেন। কিন্তু সবাই বলে ‘মইনুল’ হোসেন। তাঁর জন্ম তারিখ ১৭ মার্চ, কিন্তু অনেকে লেখেন ৫ মে। তাঁর জন্মস্থান ঢাকায় কিন্তু লেখা হয় মুন্সিগঞ্জে। ’
প্রয়াত মাইনুল হোসেনের স্ত্রী আসমা আকতার বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নকশা। তবে আমাদের কাছে এই স্মৃতিসৌধ যেমন গর্বের তেমনি বেদনারও। এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে সেই দিনগুলো। অধীর আগ্রহ আর গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছিলাম স্মৃতিসৌধের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির জন্য। তবে দুঃখজনক হলো, সে দিন মাইনুলকে আমন্ত্রণটুকু পর্যন্ত জানানো হয়নি।
মনে পড়ে আমাকে নিয়ে মাইনুল তার প্রাণের নকশার বাস্তবায়ন দেখতে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন জনসাধারণের জন্যে খুলে দেয়া হয়েছিল এই স্মৃতিসৌধ।
মাইনুলের মাঝে ছিল সাতের প্রভাব। সেই ভাবনা থেকেই এই নকশা। আমাদের কাছে সেই নকশার ব্লুপ্রিন্ট রয়েছে। তাতে বেদীর সামনে অগ্নিশিখা থাকার কথা ছিল। অথচ তা নেই। স্মৃতিস্তম্ভের যে উচ্চতা নকশায় ছিল তাও অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়াও স্মৃতিস্তম্ভ সাদা মার্বেল পাথরে মুড়ে দেবার কথা নকশায় থাকলেও সেটা করা হয়নি। এসব দিক বিবেচনা করা হলে বলাই যায়, মাইনুলের নকশার সাথে স্মৃতিসৌধটির বেশ কিছু অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা রয়েছে। ’
এব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্মৃতিসৌধের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক বাংলানিউজকে জানান, প্রায় তিন দশক আগে স্মৃতিসৌধের কাজ হয়েছে। সেই সময়ে যারা কাজ করেছেন তারা নকশা ধরেই কাজ করেছেন।
তবে মূল নকশার তুলনায় বর্তমান স্মৃতিসৌধটি যে ‘অসম্পূর্ণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ’ সে প্রসঙ্গটি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মূল নকশার সাথে নির্মিত সৌধের তফাত থাকার বিষয়ে আমাদের বিভাগের কিছু জানা নেই। স্মৃতিসৌধের বর্তমান আদলে যা রয়েছে তা-ই আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করছি। আপাতত স্মৃতিসৌধের কোথায় পরিবর্ধন বা নতুন কিছু সংযোজনের বিষয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই। ’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ১০টি প্রতীকী গণকবর রয়েছে। কোনও বীরশ্রেষ্ঠ বা মুক্তিযোদ্ধার কবর অন্য স্থান থেকে এখানে স্থানান্তরেরও কোনও পরিকল্পনা আপাতত নেই। ’

বাংলাদেশ সময়: ২২০৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫