ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

কেমন আছে পর্যটন শিল্প

মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৪
কেমন আছে পর্যটন শিল্প ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের অন্যান্য খাতের মতো পর্যটন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের পুরো অংশই পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশের পর্যটন এলাকাগুলো।



চলমান অস্থিরতায় বিদেশি পর্যটকদের অধিকাংশই  তাদের বুকিং  বাতিল করেছেন। এমন  কি অভ্যন্তরীণ পর্যটকও পর্যটন থেকে একরকম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা কক্সবাজার, সুন্দরবন এবং চট্টগ্রাম পার্বত্যাঞ্চল ২০১৩ সালের পুরোটাই বলতে গেলে পর্যটকশূন্য ছিলো। এমনকি ২০১৪ সালের প্রথমেও পর্যটকদের উপস্থিতি দেখা যায়নি এসব এলাকায়।

পর্যটন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা গড়ে ৫০ লাখ। কিন্তু ২০১৩ সালে এ পর্যটকের সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দেড় লাখে।

ফলস্বরূপ পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত ট্রান্সপোর্ট, হোটেল-রিসোর্টও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

২০১২ সালে পর্যটন খাতের উল্লেখযোগ্য সফলতার পর ২০১৩ সাল পর্যটনশিল্পের জন্য একটা ভালো সময় বলে আশা করেছিল সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু  অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এর পথরুদ্ধ করে দিয়েছে।
 
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংস কর্মকাণ্ডে গত বছর প্রাণ হারিয়েছেন দুইশ’রও বেশি মানুষ, এছাড়া হাজারেরও বেশি লোক এর সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এছাড়া পুরো দেশের মানুষ তো এক ধরনের আতঙ্কে ভুগছেই। মানুষ যেখানে জীবন নিয়েই সংশয়ে যেখানে ঘুরতে যাওয়া তো দূরের কথা। আর এর বড় শিকার হচ্ছে পর্যটন খাত। এমনতি চলতি বছরও এ লক্ষণই দেখা যাচ্ছে।

সরকারকে এটা কোনো ভাবেই ভুলে গেলে চলবে না যে, পর্যটন খাত বাংলাদেশর বেসরকারি খাতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এবং পর্যায়ক্রমে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

পর্যটনসূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে মোট জিডিপির ৪.৩ শতাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৯ হাজার চারশ ৮০ কোটি টাকা। যা ২০১৩ সালে বেড়ে ৭.৫ শতাংশ হতে পারতো বলে ধারণা করা হয়েছিলো। ২০২৩ সাল নাগাদ গড়ে যা ৬.৮ শতাংশে দাঁড়াতো। টাকার অঙ্কে এটি প্রায় ৮১ হাজার নয়শ’ ৪০ কোটি টাকা।

২০১২ সালে পর্যটন খাত থেকে যে পরিমাণ টাকা এসেছে তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ১৯ হাজার তিনশ’ কোটি টাকা এসেছে অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত থেকে। যা মোট জিডিপির ২.১ শতাংশ।  

এছাড়া শুধুমাত্র ২০১২ সালেই পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত ছিলো ১২ লাখ ৮১ হাজার পাঁচশ’ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যা মোট চাকরি খাতের ১.৮ শতাংশ। আশা করা হয়েছিলো যা ২০১৩ সালে ৪.৪ হারে বৃদ্ধি পাবে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সাল নাগাদ তা মোট চাকরি খাতের ১.৯ শতাংশ হবে। পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর মোট সংখ্যা ১৭ লাখ ৮৫ হাজার হবে বলে ধারণা করা হয়েছিলো।

যদি পর্যটন খাতে ধস নামে তবে এ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনেও যে ধস নামবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।    

পর্যটনের ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের এ উন্নয়ণের ধারা গত বছরের ধারাবাহিকতার ফল হওয়ার কথা। কিন্তু  দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ শিল্পের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। মূলত এ ধরনের প্রভাব পর্যটন খাতের জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। এমন কি সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন এটা পর্যটন শিল্পকে স্থবির করে দিতে পারে। এ নেতিবাচক প্রভাব থেকে আসলেই আগামী দিনগুলোতে পর্যটন খাত বের হয়ে আসতে পারে কিনা এটাই এখন দেখার বিষয়।

হরতাল, অবরোধ, যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছোড়াসহ অন্যান্য সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য অন্য কোনো উপায় না দেখে অধিকাংশ পর্যটক তাদের বুকিং বাতিল করছে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও যারা ভ্রমণ করে থাকেন তারাও তাদের বিনোদনের এ উপায়টি একভাবে বন্ধই করে দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং ট্রান্সপোর্ট সেক্টর ইতোমধ্যেই বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যদি এ অবস্থা ২০১৪ সাল নাগাদও অব্যাহত থাকে তবে এ সেক্টরটা হয়ত পুরোপুরিই ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা সেটাও প্রশ্নের বিষয়।

বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে প্রথম বেসরকারি উদ্দোগে পর্যট শিল্পের জন্ম হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাত, চড়াই-উৎড়াই পার হয়ে কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা ছাড়াই বলতে গেলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটে। মূলত চারটা বিষয় বেসরকারি ভাবে পর্যটন শিল্পের এ বিকাশকে সফল করেছে বলা যায়। এগুলো হলো- আতিথেয়তার জন্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট, থাকার জন্য রিসোর্ট, থিম পার্ক এবং যাতায়াতের জন্য ট্রান্সপোর্ট সুবিধা।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এবং বিভিন্ন ভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিদেশি পর্যটকদের নজর কাড়ছে। ২০১২ সালে বিদেশি পর্যটকদের এ আকর্ষণ এবং বুকিংয়ের রেট দেখেই মনে হয়েছিলো ২০১৩ সালে এ হার হয়ত আরও বাড়বে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ হার একেবারেই কমে গেছে।
 
২০১২ সাল পর্যটনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর ছিলো। ২০১১ সালের তুলনায় বলা যায় এ হার ১০০ ভাগই ছিলো। এ সময় প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। কিন্তু ২০১৩ সালে চলমান পরিস্থিতির কারণে অধিকাংশ বুকিং ফিরিয়ে নিয়েছে পর্যটকরা।    

বিদেশি পর্যটকদেরও অনেকেই বুকিং বাতিল করেছেন। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন যারা এসে আটকে পড়েছেন তারা।

এমন পরিস্থিতিতে যারা  বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে এসেছেন তারা সবাই না হলেও অনেকেই এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উপরন্তু এরা যখন দেশে ফিরে গেছেন, তখন এদেশের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা খারাপ ধারণাও বয়ে নিয়েছেন। আর তারা যখন এ বিষয়গুলো অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করবেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশে ভ্রমণ সম্পর্কে তারা আগ্রহ হারাবে। এতে করে বিশ্বের দরবারে আমরা যেমন ইমেজ সংকটে পড়ব, ঠিক তেমনি হারাবো বৈদেশিক মুদ্রাও।

অভ্যন্তরীণ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর  মধ্যে বান্দরবান-কক্সবাজার-সুন্দরবনে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে।

বাংলানিউজের প্রতিনিধি নুপা আলম কক্সবাজার থেকে জানান, প্রায় চারশ’র মতো হেটেল-মোটেল রয়েছে শুধুমাত্র কক্সবাজারেই। যা গত প্রায় পুরোটা বছরই মৃত ছিলো। এতে যেমন বড় বড় হোটেলের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন বিপাকে।
bb-bg
বাগেরহাট থেকে বাংলানিউজের প্রতিনিধি ইনজামামুল হক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানান, দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধে থমকে গেছে এই শিল্প। এতে বন বিভাগ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

সুন্দরবনের করমজল পর্যটন ও বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রের কর্মকর্তা আবদুর রব জানান, গত ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে এই কেন্দ্রের রাজস্ব আয় হয়েছিল প্রায় চার লাখ টাকা। আর ডিসেম্বরে রাজস্ব আয় ছিল আট লাখ টাকা। কিন্তু এ বছরের নভেম্বরে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র এক লাখ টাকা।

বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে রাজস্ব আয় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে আসঙ্কা ওই কর্মকর্তার।

তিনি আরও জানান, চলমান পরিস্থিতিতে কিছু দেশি পর্যটক এলেও নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত বিদেশি পর্যটক একেবারেই আসছে না সুন্দরবনে।

সুন্দরবন লাইভ টুরসের স্বত্বাধিকারী এবং মংলা লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রহমান জানান, বিগত বছরগুলোতে পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে বেগ পেতে হত, যাদের তারাই এখন পর্যটকের অভাবে বেকার।

গত মাসে তার প্রায় ২০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে জানান তিনি। একই অবস্থা সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য লঞ্চ মালিকেরও। রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা না এলে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

বান্দরবান পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবির সাইফুল আলম বাবলু বাংলানিউজের প্রতিনিধি সাইফুল আলম বাবলুকে জানান, প্রতি বছরের এ সময়টাতে আমাদের অনেক ব্যস্ততা থাকে। কিন্তু চলতি বছরের প্রায় প্রত্যেকটি মাসেই আমাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসা গুটিয়ে দিতে হবে।

বান্দরবান শহরের আবাসিক হোটেল ফোরস্টার এর পরিচালক মানিক চৌধুরী বলেন, গত কয়েক মাস থেকে কর্মচারীদের বেতন দিতে না পারায় অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। শীতের সময়টার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সামনের দিনগুলো ভালো যাবে বলে মনে হয় না।
bb-01
এদিকে বাংলানিউজের রাঙামাটি প্রতিনিধি শংকর হোড়কে রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক আখলাকুর রহমান জানান, প্রতিবছর রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশন সরকারকে প্রচুর রেভিনিউ জমা দিলেও এ বছর তা সম্ভব নাও হতে পারে।

সিলেট থেকে বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাব্বির আহমেদ জানান, সিলেটের অধিকাংশ হোটেল-রিসোর্ট খালি পড়ে আছে। , ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সিলেটের হোটেল-রিসোর্টগুলো বাণিজ্যিক মৌসুম।   কিন্তু এখন সে পর্যটক না পেয়ে হোটেল বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

তাছাড়া এখানে যে সংখ্যক হোটেল রিসোর্ট আছে তাতে প্রতিদিন প্রায় ৫-৬ কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। ফলে খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।