ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

সিসি ক্যামেরাই সব নয়

পারমিতা হিম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬
সিসি ক্যামেরাই সব নয়

দেখতে দেখতে চলে আসলো আরেকটা বছর। আরো একটা বইমেলা।

বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই জায়গায় ঘোরাঘুরি, আড্ডা, চায়ের কাপে ঝড় তোলা। আমি বলি ফেব্রুয়ারি মাস আমার আনন্দের মাস। অফিসের কাজকে কাজ মনে হয় না। হোক ত্রিশ মিনিটের অনুষ্ঠান, আসলে সারাদিনটাই সেই অনুষ্ঠানের আলাপ-আলোচনা আর পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। অফিসে দেখি তুষার ভাই সারাদিন কিবোর্ডে খটখট করে ঝড় তুলছেন। মেলায় ঢুকলেই সব পরিচিত মুখ নানা রকম সম্ভাষণ জানান। কবি, লেখক, সাহিত্যিক, প্রকাশক সবাই যেন আত্মার আত্মীয়। সবাই মিলে একসাথে তুমুল আড্ডা, তর্ক বিতর্ক—এভাবে সময় কেটে যায়। দেখা হয় সাংবাদিক, সহকর্মী আর সহপাঠীদের সাথেও।

লিটলম্যাগ চত্বরের সামনে দেখা হয় গম্ভীরমুখ, দাড়ি গোঁফওয়ালা তরুণ কবিদের সাথে। ফেইসবুকে সারাবছরই একজন আরেকজনের খবরাখবর রাখি—তবে দেখা হয় এই একমাসেই। প্রতি সন্ধ্যায় জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে থাকেন সহকর্মী এজি মাহমুদ, সার্জিল খান আর তাদের বন্ধুরা। তাদের সাথে একচোট আড্ডা দিয়ে আগামী প্রকাশনীর সামনে ওসমান গণি ভাইয়ের সাথে এক নজর দেখা করে যাই। সেখানে কোনো না কোনো লেখক বন্ধুর সাথে দেখা হবেই! মেলার আরেক প্রান্তে তানিম কবিরের সাথে কুশলাদি বিনিময়, মেলার সমালোচনা করে পাঠক সমাবেশের সামনে যেতেই দেখা হয় আরো বহু স্বজনদের সাথে। দেখা হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথেও। দুএকটা বই কিনে দিতে কখনো ভুল করেন না তারা। লেখক-আড্ডার স্থানে দেখি রাইসু এবং তার বান্ধবীরা বেঞ্চে বসে সমানে পা দোলায়। আমিও কিছুক্ষণ ওদের সাথে পা দুলিয়ে আড্ডা মেরে আসি।

ফোন করে নানানজন। নানান তথ্য জানতে। অমুক স্টল কোথায়, তমুক বই কোথায়, এবার কেনার মতো কী কী বই আছে, সারাক্ষণ থাকি ফোনের উপরে। কখনো কখনো একেক স্টলে নিমন্ত্রণ থাকে খাওয়া দাওয়ার। পরিচিত হই হাজার জনের সাথে, পরিচয় করাই একের সাথে অন্যের। এই মেলবন্ধনের স্থান বইমেলা। এটাই আমাদের বড় উৎসব।

এই আনন্দের ফল্গুধারা সত্যিই এবার আমাদের মধ্যে নেই। মেলার আগের সন্ধ্যায় যখন জায়গাটা একবার রেকি করতে গেলাম, অধিকাংশ প্রকাশকরাই সেখানে নেই। ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম লেখক আর প্রকাশকদের সাথে। আমন্ত্রণ জানালাম অনুষ্ঠানের।

উত্তর একটাই—নিরাপত্তা কে দেবে? কে জানত গত বইমেলাই দীপনদার জীবনের শেষ বইমেলা?

এর কোনো জবাব কি আসলেই কারো কাছে আছে? এবার মেলার পরিসর বাড়ানো হয়েছে, সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, বাড়ানো হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যাও। কিন্তু তাতে এতটুকুও কমেনি নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা। যাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে তারা এবার মেলায় না আসাটাই সমীচীন মনে করছেন।

সিসি ক্যামেরা তো আজিজ মার্কেটেও ছিল। এখনো পর্যন্ত দীপন ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান আইনানুগ ব্যবস্থা আমাদের চোখে পড়েনি। অভিজিৎ রায়কে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই, জনসমাগম আছে এমন এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এক বছর অতিক্রান্ত।   বিচার কোথায়?

শুধু সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে, নিরাপত্তার চাদরের বুলি আওড়িয়ে কারো আস্থাই অর্জন করা যাবে না। অস্বীকার করা যাবে না ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক—সবার মধ্যে আস্থাহীনতা, নিরাপত্তাহীনতার জোর গুঞ্জন। জানি না এইবার কার বলি হবার পালা, শুধু এইটুকু জানি সাহস করে বইমেলায় অংশ নিলেও আমরা কেউই আসলে নিরাপদ নই। কেননা, আমাদের ক্ষতিতে রাষ্ট্রের কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রের সার্থকতা নীরবে আমাদের হন্তারকদের নিরন্তর প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়াতেই।

তবু তো এর মধ্যেই আসবেন জলি আপা। আসবেন দীপনদার স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু কিসের জন্য দীপনদা এই মেলায় আর কোনোদিন আসতে পারবেন না, কেউ কি পারবেন এর সঠিক জবাব দিতে?

পারমিতা হিম
লেখক, সাংবাদিক
সময় টেলিভিশনে কর্মরত

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬
টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।