ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

যারা এনে দিল সফল সমাপ্তি

আসাদ জামান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৬
যারা এনে দিল সফল সমাপ্তি ছবি: দীপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: প্রথাবিরোধী লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে নির্মমভাবে হত্যা অথবা রাতের আঁধারে সুরক্ষিত মেলায় রহস্যজনক আগুনের তিক্ত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাষার মাসের প্রথম দিন শুরু হয়েছিল এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
 
শুরুর দিন থেকেই অজানা শঙ্কার মধ্যে থাকা আয়োজক, লেখক, প্রকাশক, পাঠক, দর্শনার্থী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও সাধারণ মানুষ মনে প্রাণে চেয়েছিল মেলার সফল সমাপ্তি।


 
সব পক্ষের এই আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী পর্ব থেকে শুরু করে সোমবার (২৯ ফেব্রয়ারি) মেলার পর্দা নামা পর্যন্ত পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা ও ডেস্কোসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা ছিলেন সদা প্রস্তুত।
 
সবার আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম, দায়িত্বশীল ভূমিকা ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ় অঙ্গীকার এবারের বইমেলা পেয়েছে সফল সমাপ্তির স্বাদ।
 
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই টানা ২৯ দিনব্যাপী মেলা সফল করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। আর এই দুই সংস্থাকে নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা দিয়েছে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।  
 
দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের বই মেলায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শুরু থেকেই একটা মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা।
 
এরই প্রেক্ষিতে নিউমার্কেট, নীলক্ষেতে, কাঁটাবন, শাহবাগ, টিএসসি, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখাঁরপুল মোড়, শিববাড়ি মোড়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকাসহ মেলার চারদিকে কয়েক বর্গকিলোটার এলাকাজুড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে পুলিশ বাহিনী।
 
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোট নয়টি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়। এই নয়টি টাওয়ারের মধ্যে সাতটিতে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ সদস্যরা। বাকি দু’টিতে দায়িত্ব পালন করেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা।
 
মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্থাপন করা হয় পুলিশ ও র্যাবের আলাদা দু’টি কন্ট্রোল রুম। একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয় পুলিশের আরেকটি সাব কন্ট্রোল রুম।
 
সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে মেলার দুই অংশেই স্থাপন করা হয় ফায়ার সার্ভিসের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম। প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিসের একাধিক গাড়ি ও সরঞ্জাম।
 
এছাড়া, মেলার কয়েকটি স্থানে বসানো হয় পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক বক্স। মোটর বাইক ও খোলা জিপে সার্বক্ষণিক টহল দেয় এই দুই সংস্থার বিশেষ টিম।
 
মেলার সবগুলো প্রবেশ ও বেরনোর পথে বসানো হয় একাধিক মেটাল ডিক্টেটর গেট। এসব গেটে পুরুষ ও নারী পুলিশের চৌকস সদস্যদের পাশাপাশি পদস্থ কর্মকর্তারাও ডিউটি করেন।
 
মেলা নির্ঝঞ্ঝাট রাখতে দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত ফুটপথে রকমারি পণ্যে পসরা সাজিয়ে বসতে দেওয়া হয়নি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। মেলা প্রাঙ্গণ ও চত্বরকে ঘোষণা করা হয় হকার, ধূমপান ও ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা হিসেবে। ম্যাচ-দেশলাই নিয়ে মেলায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি কাউকে। এমনকি শাহবাগ-ছবির হাট থেকে শুরু করে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ফুটপাতের পাশে থাকা স্থায়ী চায়ের দোকানগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মহা এ কর্মযজ্ঞ সফল করতে প্রতিদিন গড়ে ১৫ শ’ পুলিশ সদস্য নিরবচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি  র‌্যাবের অর্ধশত সদস্য মেলা ও এর আশপাশের এলাকায় দিন-রাত কাজ করেন।
 
বইমেলার ২৭তম দিন শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ চত্বর সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট পেরোতেই দেখা হয় পুলিশের ১০ সদস্যের সঙ্গে।
 
মেলা চত্বর থেকে প্রায় দুইশ’ মিটার দূরে কর্তব্যরত এই পুলিশ সদস্যরা জানান, সোহওরায়ার্দী উদ্যানের ভেতরে প্রায় ২৫টি স্পটে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ’ পুলিশ সদস্য ডিউটি করছেন। ১০ জনের একেকটি টিম মেলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে মেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত কাজ করেছেন।
 
সোমবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) মেলার পূর্ব পাশের বাউন্ডারি সংলগ্ন পাম্প গাছের নিচে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের আরও ১০ সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। পুলিশের তরুণ এ সদস্যরা জানান, গত ২৯ দিন পালাক্রমে বইমেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। কিছুটা কষ্ট হলেও সফলভাবে মেলা আয়োজনে নিজেদের অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পেরে তার যারপরন‍াই খুশি।
 
পুলিশ সদস্য শেখ সুজন বাংলানিউজকে বলেন, প্রাণের টানে মেলায় আসা মানুষগুলোকে সার্বিক নিরাপত্তা দিতে পেরেছি। কোনো অঘটন ঘটেনি-এ জন্য ভাল লাগছে।
 
তবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখগুলোকে অগ্রাহ্য করতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেককেই। সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নবজাতকের মুখদর্শনের সুযোগও এখন পর্যন্ত পাননি কেউ কেউ।
 
মেলার সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মামুন ফরাজী প্রথম সন্তানের বাবা হয়েছেন ২০ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রিয় সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ পাননি পুলিশের এই তরুণ কর্মকর্তা।
 
সোমবার বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা মাঠের কর্মী। আমাদের কোনো কমেন্ট মিডিয়াতে যাওয়া উচিত নয়। কথা বলবেন কর্মকর্তারা। শুধু এটুকু বলি অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নয়দিন আগে জন্ম নেওয়া প্রথম সন্তানের মুখ এখন পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়নি।
 
শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থার সদস্য ও কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দায়িত্বশীল ভূমিকা এবারের বইমেলাকে সফল সমাপ্তির দিকে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
 
র‌্যাবের ডেপুটি অ্যাসিট্যান্ট ডিরেক্টর (ডিএডি) মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েক বছর ঘটে যাওয়া কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে এবার মেলায় বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এর সুফলও পাওয়া গেল। পরিশ্রম একুট বেশি হলেও এখন ভাল লাগছে।

এদিকে মেলার সফল সমাপ্তিতে খুশি প্রকাশক ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মীরা।
 
সোমবার মেলার শেষ দিন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের বিক্রয় উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. জরিফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, একদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া এবারের বইমেলা ছিল শতভাগ সফল। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। বিক্রিও হয়েছে বেশ।
 
ঐতিহ্য প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী আমজাদ হোসেন কাজল বাংলানি‌উজকে বলেন, সবদিক থেকেই এবারের বইমেলা চমৎকার কেটেছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিক্রিও ছিল সন্তোষজনক। আর এ ক্রেডিট আয়োজক-আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি লেখক, পাঠক ও দর্শনার্থীদেরকেও দিতে হবে।
 
মেলার সফল সমাপ্তিতে বইয়ের পাঠক ও ক্রেতারাও খুশি। সোমবার মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কথা হয় রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে আসা বইপ্রেমী তৌহিদুর রাহমান চৌধুরীর সঙ্গে।

বাংলা‌নিউজকে তিনি বলেন, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া এবারের বইমেলা সফলভাবে শেষ হওয়ায় খুব ভাল লাগছে। এজন্য আয়োজক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৬০২ ঘণ্টা, মার্চ, ২০১৬
এজেড/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।