ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

‘চাইরোপাকে পানি, হাতোত কাজ নাই’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৭
‘চাইরোপাকে পানি, হাতোত কাজ নাই’ বন্যায় বাঁধে আশ্রয় নেয়া মল্লিকা বেগম। ছবি: ফজলে ইলাহী স্বপন

কুড়িগ্রাম: “হুর হুর করি পানি আসিয়্যা বাড়ি-ঘর সউগ তলে গেইল। হটাৎ করি বাড়িত বানের পানি ওঠায় এক কাপড়েই জীবন নিয়্যা বাঁধোত আসি উঠছি। সাথে কিছুই নিব্যার পাই নাই। চাইর দিন ধরি প্লাস্টিক টানিয়া বাঁধোত আশ্রয় নিয়্যা আছি।”

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাটেশ্বরী স্লুইস গেট বাঁধে আশ্রয় নেয়া মল্লিকা বেগম (৩৫) এভাবেই বাংলানিউজের সামনে তুলে ধরেন নিজের অসহায়ত্বের কথা।

তিনি বলতে থাকেন, “!চাইরোপাকে পানি।

ছওয়ার বাপ তো বেকার, হাতোত কোন কাজ নাই। এ্যলা খাবার বলতে নদীত মারা মাছ আর ধার কর্য্য করি অল্প চাউল কিনি কোনমতে খ্যয়া না খ্যয়া বাঁচি আছি। চুলা জ্বলার তো খড়ি-খ্যাড় নাই, রান্ধি কি দিয়্যা আর খাই কি। ”

মল্লিকা বেগমের বাড়ি ছিলো পার্শ্ববর্তী হলোখানা ইউনিয়নের টেপরির চরে। বাড়ি-ঘরে হঠাৎ করে পানি ওঠায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। এরকম অবস্থা বাঁধে আশ্রিত জোৎস্না বেগম (২৫), আকলিমা খাতুন (৩০) সহ দুই শতাধিক পরিবার।

মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার এবং সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। পানিবন্দি ছিলো জেলার ৯ উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়নের ৪ লক্ষাধিক মানুষ।

বন্যায় বাঁধই আশ্রয়।  ছবি: ফজলে ইলাহী স্বপনসরেজমিনে মঙ্গলবার বিকেলে ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাটেশ্বরী স্লুইস গেট বাঁধের উপর বানভাসীদের প্লাস্টিকের তাঁবুতে বা টিনের চালার নিচে গাদাগাদি করে কোন রকমে দিন-রাত পার করতে দেখা গেলো। চারিদিকে পানি, তাই জালানি সংকট দেখা দেওয়ায় এক বেলা রান্না করে কোনমতে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের।

গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ঘর-বাড়ি ছেড়ে বানভাসীরা আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উচু স্থান ও পাকা সড়কে। বাঁধে আশ্রিত মানুষগুলোর দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। হঠাৎ করেই বাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় শুধু এক কাপড়েই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসতে হয়েছে বন্যা কবলিতদের। সহায় সম্বল কিছুই সাথে নিতে পারেনি।

কেউ আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে, কেউবা পাকা সড়ক বা উঁচু স্থানে। তাদের এখন খাবার বলতে নদীতে ধরা মাছই একমাত্র ভরসা। বন্যার্তদের জন্য স্বল্প পরিসরে ত্রাণ তৎপরতা চললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশ বানভাসীর কপালে তা জুটছে না।

ভুরুঙ্গামারী-সোনাহাট সড়কের উপর থেকে পানি নেমে গেলেও যানবাহন চলাচল শুরু হয়নি। ফলে সোনাহাট স্থল বন্দরের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়ক থেকে পানি নেমে যাওয়ায় সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী পাকা সড়কের কয়েকটি স্থান ভেঙ্গে ও পানি প্রবাহিত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। কুড়িগ্রামের টগরাইহাটে রেলওয়ে সেতুর গার্ডার ধসে যাওয়ায় সারাদেশের সাথে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

বন্যায় বাঁধই আশ্রয়।  ছবি: ফজলে ইলাহী স্বপনকুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, জেলার ৯ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ৮২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪০ কিলোমিটার। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ২২ হাজার মানুষ। ৪২ হাজার ৩৫১ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হওয়ায় প্রায় ৩ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার মানুষ। ভেসে গেছে ২৩টি ব্রিজ ও কার্লভার্ট। ২৫ হাজার বানভাসী পরিবার ৪০৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বাংলানিউজকে জানান, বন্যার ফলে কুড়িগ্রামের সাথে ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সড়ক ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিকল্প নৌপথে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৬৫২ মেট্রিকটন চাল, ১৭ লক্ষ ৫ হাজার টাকা এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন চাল ও ৫০ হাজার টাকা মজুত রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।