ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

ভ্রমণভিসায় বন্যপ্রাণী গবেষণায় বিদেশিরা, সহযোগী সিজার! 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৯
ভ্রমণভিসায় বন্যপ্রাণী গবেষণায় বিদেশিরা, সহযোগী সিজার!  দুই মার্কিন গবেষক স্কট ট্রাগেসার ও অ্যালেক্স উইলস

মৌলভীবাজার: বাংলাদেশের আইনের তোয়াক্কা না করে ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন দুই বিদেশি নাগরিক। অভিযোগ আছে, বন্যপ্রাণী গবেষক শাহরিয়ার রহমান সিজারের ‘রহস্যজনক’ সহযোগিতায় এ কাজ করছেন তারা। একই সঙ্গে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বন্যপ্রণীর নমুনা বিদেশে পাচারের অভিযোগ আছে সিজারসহ এই বিদেশিদের বিরুদ্ধে।

বন বিভাগের অনুমতি না নিয়েই দুই বিদেশি ও শাহরিয়ার সিজারসহ তিনজন মিলে সম্প্রতি বিপন্ন প্রায় বনরুইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেছে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বন থেকে। যদিও বিষয়টি আঁচ করতে পেরে প্রভাব খাটিয়ে গত ২৬ জুন বনবিভাগ থেকে তড়িঘড়ি করে নিয়ম না মেনেই অনুমতি নিয়েছেন সিজার।

তবে এই অনুমতিতে সিজার কাজ করতে পারলেও বিদেশিরা কোনোভাবেই কাজ করতে পারেন না। বন আইন অনুযায়ী যা দণ্ডনীয় অপরাধ।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ঈদের ছুটিতে ফাঁকা ছিল মৌলভীবাজারের কলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া উদ্যান। সে সময় পর্যটক হিসেবে ঘুরতে আসা দুই মার্কিন গবেষক স্কট ট্রাগেসার ও অ্যালেক্স উইলস লাউয়াছড়া বনে ঢুকে নিজেরদের ইচ্ছেমতো কাজ করেছেন। সংগ্রহ করেছেন বনরুইয়ের নমুনা। এই কাজে তাদের সহযোগিতা করেছেন সিজার।  

লাউয়াছড়ার একজন ট্যুর গাইড নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজ জানান, তিনি ঈদের বন্ধে বিদেশিদের দেখেছেন বনে, ভেবেছিলেন তারা ঘুরতে এসেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, এই দুই মার্কিন গবেষক বনরুইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে আরো সংগ্রহ করতে শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে যান। কিন্তু সেবা ফাউন্ডেশন তাদের সহযোগিতা করেনি।  

বনের মধ্যে ঘুরছেন দুই বিদেশিবন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব জানান, কয়েকজন এসেছিলেন। সঙ্গে দু’জন বিদেশিও ছিল। তারা বনরুই হাতে নিয়ে দেখতে চাইলে আমরা তাদের হাতে দেইনি, এমনকি খাঁচা থেকেই বের করিনি।

এদিকে ঈদের সময় লাউইয়াছড়া থেকে বন্যপ্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করে তা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাকের ল্যাবে যান। তারা চেষ্টা করেন জিন সংগ্রহের। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী আকাশ বলেন, দু’জন এসেছিলেন। একজনের নাম অ্যালেক্স। অপ জন হলেন গবেষক স্কট ট্রাগেসার।  

ব্র্যাকের বায়োলজি ল্যাবে সূত্রে জানা যায়, সালমান নামে সেখানকার এক সাবেক কর্মচারীর মাধ্যমে ল্যাবে যান স্কট ও অ্যালেক্স। তারা দেশের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী রক্ষায় কাজ করেন বলে দাবি করে বনরুইয়ের জিন নিয়ে গবেষণা করতে চান ব্র্যাকের ল্যাবে। তবে ল্যাব খালি না থাকা ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় সেসময় তারা কাজ করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন ল্যাব সহকারী আসমা আফজাল।  

অভিযোগ রয়েছে, এসব কাজের পেছনে ও বিদেশিদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা বেসরকারি একটি সংগঠন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান সিজার। তবে সিজারের দাবি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে কাজ করছেন তারা। আর ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের দাবি, সংগঠনের অগোচরে এসব করছেন সিজার।  

বনরুিই হাতে শাহরিয়ার সিজার রহমানক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স প্রতিষ্ঠাতা আসিফ ইবনে ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, সিজার গত তিন মাসে সিসিএ-এর নাম ব্যবহার করে যে কাজগুলো করছেন এগুলো নিজের উদ্যোগে করছেন। গত তিন মাস ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের (সিসিএ) সঙ্গে যুক্ত না হয়েও বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে সিসিএর পরিচয় দিচ্ছেন, সিসিএর হয়ে মিটিং করছেন, ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, ভাওয়ালে যাচ্ছেন, প্রোজেক্ট চালাচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশি নাগরিক স্কট বাংলাদেশে সাতবার এসেছেন। প্রতিবারই টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসেছেন এবং অ্যালেক্স একবার এসেছেন। সিজার এতদিন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সে (সিসিএ) যুক্ত হয়ে কাজ করলেও অ্যালেক্স এবং স্কটের কারোরই সিসিএতে কোনো পোস্ট নেই। স্কট বাংলাদেশে বনরুই নিয়ে বিদেশি একটি প্রকল্পে কাজ করার জন্য বনবিভাগের কাছে অনুমতি চাইলেও বনবিভাগ অনুমতি দেয়নি।  

এরপর তিনি সিজারের সহযোগিতায় ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে কাজ শুরু করেন। সিজার বর্তমানে অনুমোদন নিয়ে কাজ করলেও গত ২৬ জুনের আগে তার কোনো অনুমোদন বন বিভাগ থেকে ছিল না, অনুমোদন না পেয়েও নিজে বিভিন্ন বনে বিদেশিদের নিয়ে যান এবং বনরুইয়ের নমুনা সংগ্রহ করেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

সিজারকে লাউয়াছড়া বনে মৌলভীবাজারে স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা করে আসছেন ফুলবাড়ী চা বাগানের চঞ্চল। চঞ্চলের সঙ্গে কয়েকদিন চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে বাগানে গিয়ে তার খোঁজ করলে জানানো হয় কয়েকদিন ধরে এলাকায় নেই।

এ বিষয়ে শাহরিয়ার রহমান সিজার বাংলানিউজকে বলেন, ২৬ জুন পারমিশন পাওয়ার আগে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্টে কাজ করার জন্য আবেদন করা হয়েছে।  

তবে দু’জন বিদেশি নিয়ে লাউয়াছড়া বনে যাওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।  

বনরুইয়ের নমুনা সংগ্রহ করতে বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে গেয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যাইনি তবে আমার কলিগরা যেতে পারে।

এদিকে বনরুই নিয়ে কাজ করার জন্য গত ২৬ জুন তড়িঘড়ি করে শাহরিয়ার সিজারকে যে অনুমতি বন বিভাগ দেয়, এর নেপথ্যে প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী কাজ করেছে বলে জানা যায়।  

প্রভাবশালীর চাপে তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তরের বন সংরক্ষক (অর্থ ও প্রশাসন) জাহিদুল কবির। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা অনুমতি দিয়েছি গত ৪/৫ দিন আগে। কিন্তু কিজন্য দিয়েছি? ঢাকার সরকারদলীয় একজন প্রভবশালী সুপারিশ করেছেন। তাই এই অনুমতি দিতে হবে।

কিন্তু এ অনুমোদন নিয়মবহির্ভূত বলে দাবি করেন বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী গবেষণা কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ।  
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষক কমিটি যদি সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে আমাদের প্রধান বন সংরক্ষক অনুমোদন দিতে পারেন। এছাড়াও অন্য কেউ দিতে পারবেন না।

এ বিষয়ে প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এম শামসুল মুহিত চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, শাহরিয়ার সিজার রহমান ২৬ জুন ঢাকা থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন চারজনের। তবে সেখানে কোনো বিদেশির কথা উল্লেখ ছিল না। এর আগে যদি তারা অবৈধভাবে ঢুকে থাকে তাহলে প্রমাণ পেলে বন বিভাগের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, যদি কেউ অনুমতি নিয়েও আসে তাহলে সেটা আমাদের অবশ্যই জানাতে হবে। জানিয়ে বনে ঢুকতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে একজন বনকর্মী থাকবেন। তারা কি স্যাম্পল নিয়ে যাচ্ছে সেটাও অবশ্যই বন বিভাগের কাছ থেকে ভেরিফিকেশন করে তবেই নিতে হবে।

শাহরিয়ার সিজার বান্দরবানের বিভিন্ন গহীন বনে বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করেন। তার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী পাচারের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৭ সালে একবার স্থানীয়দের হাতে ধরাও পড়েছিলেন, যেটা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৩ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৯
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।