ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

তামাকের বিষ, জীবন ছুঁয়ে যায়!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৭ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৪
তামাকের বিষ, জীবন ছুঁয়ে যায়! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কাঁকারা, চকরিয়া, কক্সবাজার ঘুরে এসে: ঘরের সামনের বারান্দায় দোলনায় দুলছে পাঁচ মাসের শিশু। তার মাথার ওপরে টিনের চালে, আশপাশের বেড়ায়, এমনকি ঘরের সামনে মাচা পেতে তামাক পাতা শুকানো হচ্ছে।

খানিক দূরে তামাকের চুল্লির আগুন বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আট বছরের শিশু মিল্টন। আর ওদের মা সাফিয়া বেগম শুকনো তামাক পাতা প্যাকেটবন্দি করতে স্বামীকে সাহায্য করছেন।

তামাকের ভর মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার তামাক চাষ অধ্যুষিত কাঁকারা এলাকার একটি বাড়ির চিত্র এটি।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের কাঁকারা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে চোখে পড়ে তামাক চাষিদের নানা কর্মকাণ্ড। প্রায় সব বাড়িতে এখন ব্যস্ততা তামাক কাটা, শুকানো, প্যাকেটবন্দি করা আর বাজারজাতকরণে। বাড়িতে বাড়িতে চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে তামাক পাতা, গ্রামের বাজারে বাজারে বসছে তামাকের হাট।      

সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পারে, তামাক চাষের কারণে কারও বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসা বন্ধ, কারও মাস খানেক খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, কেউবা ভূগছেন শ্বাসকষ্টে। জোরালো প্রতিবাদ পরিবার থেকেই। তবুও তাদের জীবিকা তামাক চাষে। চাষির যুক্তি, আর তো কিছু করার নেই। জীবনটা তো চালিয়ে নিতে হবে। তামাক চাষে সুবিধা পাই, দামও ভালো। অন্য ফসল আবাদে সুবিধাও মেলে না, দামও মেলে না।

চকরিয়ার সদর রাস্তা ধরে জিদ্দাবাজার, সেখান থেকে কাঁকারার পথে। কোনো বাড়িতে ঢোকার প্রয়োজন নেই, রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেই তামাকের ঝাঁঝ এসে নাকে লাগে।

চাষি শাহাবুদ্দিনের বাড়ির চুল্লিতে (স্থানীয় ভাষায় টণ্ডুল) পোড়ানো হচ্ছিল তামাক পাতা। ঘরের চালা, চালার সিলিং, ঘরের সামনের খোলা জায়গাসহ পুরো ঘর জুড়ে তামাকের আগ্রাসন। বাড়ির দুই ছোট ছেলে মহিউদ্দিন আর আফিল উদ্দিন মুখে মাস্ক পরে ঘুরছে।

তামাক চাষি শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী ইয়াসমিন আকতার বাড়ির সবাইকে সুস্থ রাখতে জগে করে ট্যাং গোলানো পানি নিয়ে ঘুরছেন। কখনো চুল্লির দায়িত্বে থাকা জাফর আলমের হাতে দিচ্ছেন এক গ্লাস, কখনো বা ছেলের হাতে। তার অস্টমশ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে প্রায় একমাস আগে থেকে। এই সময়টাতে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসা বন্ধ করে দেন।

ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলতে চান ইয়াসমিন। কিন্তু তার ভয়, কেউ কী আসবে এই বাড়িতে!

চাষি শাহাবুদ্দিন যখন ঘরের মেঝেতে দু’জন শিশু শ্রমিককে নিয়ে শুকনো তামাক পাতা প্যাকেটজাত করছেন, তখন বাইরে থেকে আসা সংবাদকর্মী দেখে স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তারের প্রতিবাদী উচ্চারণ, ‘ভাই একটু লিখে দেন। আমরা তো সমাজের বাইরে চলে যাচ্ছি। বাড়িতে লোকজন আসা বন্ধ। আমরা খাওয়া-দাওয়া করতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করতে পারে না’।

শাহাবুদ্দিন হিসেব কষে দেখালেন, ধান আবাদের চেয়ে সামান্য লাভ তামাক চাষে। ধান উৎপাদন করলে যেখানে তিনি ৭০ হাজার টাকা পেতেন, তামাকে পাচ্ছেন ৭০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু দেনাসহ অন্যান্য কারণে এই বৃত্ত থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, জানালেন তিনি। তাছাড়া তামাক চাষ করলে কিছু সহায়তা পাওয়া যায়, ধান করলে তেমন কোনো সহায়তা মেলে না। হিসেব কষে শাহাবুদ্দিন বললেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হবে না, এমন একটা কাজ চাই, পাচ্ছি না তো’!

কাঁকারার তামাক চাষি সৈয়দ আহমদ, আব্দুল কাদের কিংবা নাসির উদ্দিনের হিসাবও একই রকম। সামান্য লাভ, হয়তো কিছুটা ‘ভালো’ আছেন, কিন্তু এর আড়ালে যে অনেক বেশি ‘খারাপ’ আছেন, সেটা বোঝেন সবাই। সামান্য অর্থকড়ির লোভে তারা শেষ করে দিচ্ছেন সব।

তামাক চাষের ক্ষতির দিকগুলো তুললেন চাষিরাই। বাংলানিউজকে বললেন, এ এলাকায় আগে প্রচুর পরিমাণে গাছ ছিল, এখন নেই। মাঠে মাঠে ছিল সোনালী ফসল, এখন নেই। তামাকের আগ্রাসনে সব শেষ হয়ে গেছে।

তারা জানান, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে হারিয়ে গেছে জমির উর্বরাশক্তি। চুল্লিতে তামাক পোড়াতে গিয়ে বন উজাড় হয়ে গেছে। সারা বছরের পরিবারের সদস্যদের মুখে তুলে দেওয়ার মতো খাবারটা এই মাঠেই উৎপাদন হতো। এখন সে দিন তো ফুরিয়েছে। উপরন্তু রোগ-বালাইয়ে ওষুধ কিনতে চলে যায় অনেক টাকা।    

তামাক চাষে লাভ আর নানা সুবিধাদির খাতা খুলে বর্গাচাষি সৈয়দ আহমদ দেখালেন, এক একর জমিতে তামাক চাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। এর মধ্যে ছয় মাসের জন্যে জমির মালিককেই দিতে হয় এক লাখ টাকা। এই জমির তামাক পোড়াতে লাগে প্রায় ৩০০ মন কাঠ। এর দাম ৩০ হাজার টাকা। শ্রমিক, তামাক পোড়ানোসহ আরও অনেক খরচ রয়েছে। মৌসুম শেষে সব খরচ বাদে তার হাতে হয়তো লাখ খানেক টাকা থাকবে। তবে চাষের জন্য কোম্পানি কিছু সুবিধা পান তারা।

সুত্র বলছে, এ বছর চকরিয়া উপজেলার প্রায় সাত হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। একাধিক টোব্যাকো কোম্পানি চাষিদের অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এবার দ্বিগুণ জমিতে তামাক চাষ করিয়েছে। চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়নে তামাক চাষ হয়েছে।

ইউনিয়নগুলো হলো- কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাঁকারা, ফাঁসিয়াখালী, চিরিংগা, লক্ষ্যারচর, সাহারবিল ও বমুবিলছড়ি। এসব ইউনিয়নের চাষিরা টোব্যাকো কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে বিপুল পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করেছেন। এছাড়া মাতামুহুরী নদীর জেগে উঠা চর দখল করে প্রভাবশালীরা তামাক চাষ করেছেন।

এলাকার জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, এনজিও কর্মী যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই তামাক চাষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলেন, তামাক চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু এখানে নিয়োজিত টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর লোভের ফাঁদে পড়ে কৃষকরা তামাক চাষ করছেন। তামাক চাষের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে আবাদি জমি।

তারা বলেন, তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির অনুজীব নষ্ট হচ্ছে এবং জমি হারাচ্ছে উর্বরতা শক্তি। পরবর্তীতে ওই জমিতে শত চেষ্টা করেও কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

উপজেলার একদিকে ক্ষতিকর জেনেও প্রতিযোগিতামূলক তামাক চাষ চলছে। চাষিরা পাচ্ছেন বিশেষ প্রণোদনা। আর একই উপজেলার অন্যপ্রান্তে সম্ভাবনাময় লবণ চাষিরা প্রণোদনা তো পাচ্ছেনই না, মিলছে না ন্যায্য মূল্যটাও।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।