ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

দুর্যোগে সচেতনতা বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১৩ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৪
দুর্যোগে সচেতনতা বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাউথখালী, শরণখোলা, বাগেরহাট থেকে: সিডরের মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের মুখে পড়ে শরণখোলার সাউথখালীসহ আশপাশের এলাকার মানুষ এখন দুর্যোগে অতিমাত্রায় সচেতন। একসময় ৫ নম্বর সিগন্যালও যে মানুষগুলোকে ঘর থেকে বের করতে পারতো না, তারা এখন আকাশে মেঘ দেখলেই আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন।

কিন্তু মানুষের এই সচেতনতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেনি।

সরজমিনে ঘুরে জানা গেছে, সিডরের পর সাউথখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার হলেও এতে ধারণক্ষমতা অনেক কম। ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত ঘোষণা হলে এই শেল্টার সেন্টারগুলোতে তিল ধারনের ঠাঁই থাকে না। অনেকে সেখানে জায়গাও পান না। এমনও দেখা গেছে, একইস্থানে একাধিক শেল্টার সেন্টার রয়েছে, আবার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কোনো শেল্টার নেই। অনেকগুলো আবার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী। অনেকস্থানে শেল্টারে যাওয়ার রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ।

সূত্র বলছে, সিডরের পর সাউথখালী ইউনিয়নে বেশকিছু সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার এবং স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। পুরানো শেল্টার সংস্কারও হয়েছে। নির্মিত হয়েছে রাস্তাঘাট। কিন্তু এসব কার্যক্রম পরিচালনায় সমন্বয়ের যেমন অভাব ছিল, তেমনি মানুষের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আর এ কারণেই ইউনিয়নের ২৩টি স্থানে ২৯টি সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার ও স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হয়েছে।

ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় এ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই কম। রায়েন্দা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে শেল্টার সেন্টার আছে মাত্র একটি। এর ধারণক্ষমতা ৬০০ জনের। অথচ এই ওয়ার্ডে লোকসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। বাকি লোকের আশ্রয়ের সুযোগ নেই। গোটা শরণখোলা উপজেলায় বড় দুর্যোগ হলে মাত্র ১০ ভাগ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা পাবে। আশ্রয়কেন্দ্রে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে নামেমাত্র। দুর্যোগের সময় নিচু টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে উঁচু টয়লেটের ব্যবস্থা নেই।

রায়েন্দা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার বাংলানিউজকে জানান, রাস্তাঘাটের সমস্যার কারণে সিডরের সময় এই এলাকার বহু মানুষ আশ্রয়ে ফিরতে পারেনি। কিন্তু এখনও রাস্তাঘাটের তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। তবে মানুষের সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
উত্তর সাউথখালী গ্রামের লোকমান হোসেন বলেন, সিডরের পর সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার হলেও সেখানে যাওয়ার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি। শেল্টারে গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যায় না। আমরা নদীর কূলে থাকি। এখানে যে নতুন বেড়িবাঁধ বানানো হয়েছে, তা ততটা শক্ত হয়নি।

তবে সিডরের পর দুর্যোগ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা যে বেড়েছে, তা বোঝা যায় এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে। কাউকে এখন আর সাইক্লোন শেল্টারে যেতে বলতে হয় না। নিজের ইচ্ছায়ই তারা ছুটেন সেখানে।

তাফালবাড়ি বাজারের কাছে পুরাতন লঞ্চঘাটের বাসিন্দা আব্দুল মালেক মৃধার স্ত্রী রাহিমা বেগম অনেকটা মুখস্থই বলে ফেললেন, দুর্যোগে এক নম্বর পতাকা দেখা গেলে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে, দুই নম্বর পতাকা দেখলে সব মালামাল গুছিয়ে নিতে হবে আর তিন নম্বর পতাকা দেখলে ঘরে থাকা যাবে না।

দুর্যোগ সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রমে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সিডরের পরের দুর্যোগ আইলা ও মহাসেনের সময়ের সিগন্যালে মানুষের সচেতনতার মাত্রা বোঝা গেছে। শুকনো খাবার নিয়ে বাড়িঘর থেকে মানুষজন ছুটে এসেছে সাইক্লোন শেল্টার সেন্টারে। তখন শেল্টারগুলোতে তিল ধারনের ঠাঁই থাকছে না। অথচ সিডরের তাণ্ডবের আগে মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও সাইক্লোন শেল্টারে আনা সম্ভব হয়নি।

দুর্যোগ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি এলাকাবাসীর। তারা বলছেন, দুর্যোগের সময় শেল্টারে যেতে রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে হবে। সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আরও সেন্টার নির্মাণ করতে হবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অগ্রদূত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আইউব আলী আকন বাংলানিউজকে বলেন, সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলায় প্রয়োজনের তুলনায় সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার এখনও অনেক কম। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে এগুলোকে কার্যকর করা সম্ভব। সেজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

দুর্যোগ সচেতনতা বিষয়ে কর্মরত সংস্থা জেজেএস এর কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, পরিবার পর্যায়ে এই এলাকার মানুষ অনেক বেশি সচেতন। বাড়িঘর উঁচূকরণ, সতর্ক সংকেত মেনে চলা, আশ্রয়ের জন্য যথাসময়ে কেন্দ্রে আসা, এসব বিষয়ে মানুষ বেশ সজাগ। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে পরিবার পর্যায়ের ওই সচেতনতা কাজে লাগবে।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন

এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৭ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।