ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ওষুধ, তাবিজ-কবজ এক দোকানে!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৪
ওষুধ, তাবিজ-কবজ এক দোকানে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর কলাতলী, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে: এখানে এলোপ্যাথিক ওষুধ পাওয়া যাবে। মিলবে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ।

চাইলে তাবিজ-কবজের দাওয়াইও আছে। এজন্য রোগীদের দশ ঘর ঘুরতে হবে না। সবই আছে এক ‘চিকিৎসকের’ কাছে। তবে পল্লী চিকিৎসকের একখানা সনদও এদের কাছে নেই। আর এই ‘চিকিৎসায়’ই ভরসা প্রায় ২২ হাজার মানুষের। অসুখে অসহায় মানুষ এদের কাছেই ছুটে যান। এই চরে সরকারি ডাক্তারের দেখা পাওয়ার চিন্তাই করা যায় না!

দ্বীপ জেলা ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার চর কলাতলীর চিকিৎসা সেবার হাল এমনই। ওই চরে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে চিকিৎসা সংকটের কথা জানাতে গিয়ে চরের কয়েকজন নারী বাংলানিউজকে বলছিলেন, ডাক্তার কবিরাজ তো দূরের কথা। অসুখ হলে ‘খনকার’ও মেলে না। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ অঞ্চলে ‘খনকার’ নামের একটি শ্রেণী রয়েছে, যারা তাবিজ-কবজ দিয়ে নানান রোগের দাওয়াই দিয়ে থাকেন।

চর কলাতলীর প্রাণকেন্দ্র বলে খ্যাত আবাসন বাজার ঘুরেই ধারণা পাওয়া যায়, স্থানীয়ভাবে ‘ডাক্তার’ নামে পরিচিত ব্যক্তিদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালোই। সঠিক উচ্চারণে ওষুধের নামও বলতে পারছেন না, অথচ শুধু ওষুধ বিক্রি নয়, ছোটখাট চিকিৎসাও করেন এসব ডাক্তার। বেক্সিমকো কোম্পানির Frenxit ট্যাবলেটকে একজন ডাক্তার লিখে দিলেন Fengit। রোগী তো কোথাও এ ওষুধ খুঁজে পেলেন না। অবশেষে ওষুধের প্রকৃত নাম উদঘাটন হলো। এসব ‘ডাক্তারের’ কাছে আসা রোগীরা এভাবেই প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে।  

বাজার ঘুরে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি ওষুধের দোকানে এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ও গরু-ছাগলের ওষুধ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ‘ডাক্তার’ বললেন, এখানে তো ভাই চিকিৎসা করার মত কেউ নেই। আমরা শুধু মানুষের চিকিৎসা নয়, গরু-বাছুরের চিকিৎসাও করি। এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তো আছেই। প্রয়োজন পড়লে তাবিজ-কবজ দিয়ে ‘খনকার’-এর কাজও করি। মানুষ তো এতে সন্তুষ্ট। তাদের তো কোন অভিযোগ নেই। ’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভয়াল মেঘনার বুকে জেগে থাকা দ্বীপ কলাতলীর প্রায় ২২ হাজার মানুষ সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। ‘সব মানুষের দোর গোড়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে’ বলে সরকারি ঘোষণা এই চরের মানুষের বেলায় প্রযোজ্য নয়। বিনা চিকিৎসায় প্রতিবছর এখানে বহু মানুষ মারা যায়। জরুরি মুহূর্তে প্রসূতি মায়েদের জীবন তুলে দিতে হয় নিয়তির কাছে। চরের বেশ কয়েকটি স্থানে কথা বলার সময় স্থানীয় বাসিন্দারা সন্তান প্রসবকালে মৃত মায়েদের তালিকা তুলে ধরেন।

মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড হিসাবে এ চরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার পাওয়া যায় না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। আবার কখনো ডাক্তারের দেখা মিললেও ওষুধ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখানকার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম এতটাই অনিয়মিত, চরের অনেক মানুষ জানেনই না এখানে এ ধরনের সরকারি চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

এলাকার ইউপি সদস্য মো. জাফর উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এখানে বিভিন্ন সময়ে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। কমিউনিটি ক্লিনিক একটি থাকলেও সেখানকার ডাক্তার আসে নদীর ওপার থেকে। তাছাড়া যোগাযোগ সমস্যার কারণে চরের সব এলাকার মানুষ ওই ক্লিনিকে যেতে পারেন না। স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকজন ডাক্তার থাকলেও তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন।

যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় গজিয়ে ওঠা এই অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজি নন চরের মানুষ। তারা বললেন, এই ‘ডাক্তারা’ বিপদের বন্ধু। কোন ধরনের ডাক্তারি সনদ কিংবা প্রশিক্ষণ না থাকলেও জরুরি সময়ে এরা প্রাথমিকসহ ওষুধ দিয়ে অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ান। এরা না থাকলে চরবাসীর আরও বিপদ বাড়বে।

মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুনিল চন্দ্র দাস বাংলানিউজকে বলেন, চর কলাতলী একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এখানকার মানুষের যথাযথ চিকিৎসা পেতে অনেক সমস্যা হয়। চর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতেও প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ওখানকার বাসিন্দাদের জন্য আরও কমিউনিটি ক্লিনিক ও ডাক্তার প্রয়োজন।

চরের চিকিৎসা সংকট সম্পর্কে আলাপ হলো মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদারের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই চরের মানুষ চরম দুরাবস্থার মধ্যে আছে। এখানে একটি ক্লিনিক আছে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারী মনপুরা সদর হাজীরহাট থেকে গিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। চর কলাতলীতে একজন নিয়মিত ডাক্তার প্রয়োজন। আমরা চরে একটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানাই।    

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]  ]

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।