ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

মেঘনা পার হতে অপেক্ষা ঘণ্টার পর ঘণ্টা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৪
মেঘনা পার হতে অপেক্ষা ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মতিরহাট, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর ঘুরে এসে: যাত্রীদের অপেক্ষার প্রহর কাটে না। কারও অপেক্ষা পাঁচ ঘণ্টা, আবার কারও আট ঘণ্টা।

পার হতে হবে প্রায় ২৫ কিলোমিটার প্রশস্ত ভয়াল মেঘনা।

ফেরি না পেলে গন্তব্যে ফেরা হবে না। ডুবোচরে ফেরি আটকে যাচ্ছে নিয়মিত। ভোলার ইলিশা আর লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাটে পারাপারের জন্য আসা যাত্রীদের এই ভোগান্তি বাড়ছে দিনকে দিন।

শুকনোয় ডুবোচরের সমস্যা আর বর্ষায় ফেরিঘাট ডুবে থাকার সমস্যা।

বাংলানিউজের দেখা একদিনের ঘটনা। ইলিশা ফেরিঘাটে দুপুর ১২টা থেকে যাত্রীদের অপেক্ষা। কিছুক্ষণ আগেই একটা ফেরি ছেড়ে গেছে ঘাট থেকে। আরেকটি ফেরি আগের দিন ভোররাতে ডুবোচরে আটকা পড়ে আছে।

দিনের জোয়ারেও সেটি ঘাটে ফিরতে পারেনি। যাত্রীদের ভরসা ফিরতি ফেরি ঘাটে আসার। অবশেষে দুপুর ১২টা থেকে অপেক্ষা করে ফেরিতে ওঠা সম্ভব হলো রাতে ৮টায়। ওপারে পৌঁছাতে রাত সাড়ে ১০টা।

দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই ফেরিরুটের যাত্রী ভোগান্তির চিত্র বাংলানিউজের চোখে পড়েছে একাধিকবার।

তবে যাত্রীরা প্রায় প্রতিনিয়তই এ ঘাটে এসে চরম দুর্ভোগে পড়েন। ফেরি ঘাটে আসতে দেরি হলে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দল ভারী হয়। বাড়ে যাত্রী ও মালবাহী গাড়ির সংখ্যা। ফেরি রুট চালু হওয়ার পর থেকে একই অবস্থা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাভাবিক সময়ে মাঝখানে ভয়াল মেঘনা নদীপথে ফেরি রুটের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। জোয়ার-ভাটার প্রভাবে ঘুরে যেতে হলে এই পথের দূরত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি।

ইলিশা-মজুচৌধুরীর হাটে এই যাত্রীভোগান্তির সহজ সমাধান দিলেন লক্ষ্মীপুরের কমলনগর এলাকার বাসিন্দারা।

ভোলার ইলিশা থেকে ছেড়ে আসা ফেরি লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাটে পৌঁছাতে যেতে হয় কমলনগরের মতিরহাটের গা ঘেঁষে।

ডুবোচরের কারণে ফেরি ঘুরে যায় দীর্ঘপথ। ফলে মজুচৌধুরী ঘাটের বদলে মতিরহাটে ফেরি ভিড়লে অতি সহজেই বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যেতে পারে যাত্রী ও যানবাহন।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ২১ জেলার যাতায়াতের জন্য ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি সার্ভিস রুটটির দূরত্ব এবং সময়ের কারণে বর্তমানে যাত্রীদের কাছে ভোগান্তির রুট হিসাবেই পরিচিত।

রুটটির লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট থেকে দক্ষিণের কমলনগর উপজেলার মতিরহাট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারে ডুবোচর।

এই রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীদের দাবি, বর্তমান ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের বদলে ১০ কিলোমিটার নদীপথ কমিয়ে ভোলা-মতিরহাট রুট করা হোক। এতে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতে ও মালামাল পরিবহনে সময় কমে যাবে কমপক্ষে ৩ ঘন্টা। রুটে যানবাহনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে দ্বিগুণ ।

নিয়মিত যাত্রীসহ অন্যান্য সূত্রগুলো বলেছে, ভোলা থেকে নদী পথে লক্ষ্মীপুরের দূরত্ব (পূর্ব-পশ্চিমে) ১৮ কিমি। কিন্তু এটুকু পথ পাড়ি দিতে ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি সার্ভিস ঘুরে আসে ২৮ কিলোমিটার।

এরমধ্যে ভোলার ইলিশা থেকে পূর্ব দিকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাট পর্যন্ত ডুবোচর বিহীন ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। আবার মতিরহাট থেকে উত্তর দিকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত বাকি ১০ কিলোমিটার পথ পারাপারে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা।

নদীপথে ভোলার ইলিশা থেকে কমলনগরের মতিরহাট ফেরি ভিড়লে যাত্রী ও মালবাহী যানবাহন অতিদ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।

কমলনগরের চর কালকিনি ইউপি সদস্য এবং মতিরহাট বাজারের ব্যবসায়ী মেহেদী হাছান লিটন বলেন, শুধু ফেরি চলাচলের জন্য মেঘনার মাঝখানে চর রেখে মতিরহাট থেকে মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার জায়গা নিয়মিত ডেজিং করা হচ্ছে। ফলে মেঘনার তীর ভেঙে ক্রমান্বয়ে পূর্বদিকে সরে আসছে। ড্রেজিং না করে মতিরহাটে ফেরি স্টেশন করলে সময় আর অর্থ বাঁচবে, সেইসঙ্গে কমলনগর রক্ষা পাবে ভাঙন থেকে।

সূত্র বলছে, ভোলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক ও পিকআপ মিলে প্রতিদিন অর্ধ শতাধিক যানবাহন চলাচল করে এই পথে। কিছু যাত্রী লঞ্চ ও ট্রলারে পারাপারের জন্য এই ঘাটে আসে।

সব মিলে দুই সহস্রাধিক লোকের ভরসা এই ফেরিঘাট।

দ্বীপজেলা ভোলাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষিত ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট রুটে ফেরি চালু হয় ২০০৮ সালে। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ভোলার সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করা।

কিন্তু পাঁচ বছর পরেও সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ফেরি সংকট থেকে শুরু করে নাব্যতা সংকট পর্যন্ত রয়েছে অন্তহীন সমস্যা।

ফেরি পরিচালনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে ইলিশা ঘাট থেকে মজুচৌধুরীর হাট যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট আর মজুচৌধুরী ঘাট থেকে ইলিশা আসতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা ৫৫ মিনিট।

দুর্যোগপূর্ণ সময়ে এই সময় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় ফেরি মাঝপথেই থামিয়ে রাখতে হয়।

বিআইডাব্লিউটিসি’র অধীনে পরিচালিত ফেরি কিষাণী’র ইনল্যান্ড মাস্টার অফিসার মফিজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফেরি চলাচলের রুট এটি। আরিচা ৬ কিলোমিটার এবং মাওয়া ১২ কিলোমিটার ফেরির পথ। আর এই ফেরিকে পাড়ি দিতে হয় ২৬ কিলোমিটার পথ। এই পথে বর্তমানে দু’টি ফেরি চলাচল করছে। ঘাটের সমস্যা ঠিক করা হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমবে।

ফেরি চলাচলকারী কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, ইলিশা ঘাট সংলগ্ন রামদাসপুর ট্যাক থেকে বিরবিরি বয়া পর্যন্ত পলি পড়েছে। ইলিশা ঘাটের আশপাশেও নাব্যতা সংকট রয়েছে। জোয়ার কিংবা ভাটা কোনো সময়ই এ পথে ফেরি চলাচল করতে পারে না।

ফেরি দীর্ঘ পথ ঘুরে যেতে হয়। অন্যদিকে লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরী ঘাটে ফেরি ঢুকতে রহমত আলী খালে রয়েছে নাব্যতা সংকট। পূর্ণাঙ্গ জোয়ার ছাড়া ওই পথে ফেরি ঢুকতে কিংবা বের হতে পারে না। এই বিষয়গুলো ফেরি চলাচলে অন্যতম সমস্যা বলে জানালেন ফেরি কর্তৃপক্ষ।

সংকট নিরসনে বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই সদুত্তর। ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানালেন, এখানে ফেরি সংকট আছে। নাব্যতা সংকট আর জোয়ারের সময় ঘাট ডুবে যাওয়ার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপের কথা জানা নেই।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০২:২৬  ঘণ্টা,  ২৬ অক্টোবর ২০১৪ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।