শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ, (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: যে বয়সে পিঠে স্কুল ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রাখার কথা সেই বয়সে বৈঠা হাতে নৌকায় পা রাখে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের শিশুরা।
শিশু কিশোররা হয়ে ওঠে দক্ষ মাঝি।

undefined
এভাবেই বেড়ে ওঠে শাহপরীর দ্বীপের শিশুরা। শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার কোনো তাগিদ দেয়না কেউই। এমনকি তাদের বাবা মাও কখনো তাদের বলেনি বিদ্যালয়ে যেতে হবে। কেউ বাবার কাজে সাহায্য করে আবার কেউ নিজেই নৌকা চালায়।
দ্বীপে বড় একটি বিদ্যালয় ভবন রয়েছে কিন্তু সেখানে শিক্ষক স্বল্পতা প্রকট। দূরের এলাকার শিক্ষকদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হলেও যোগদান করতে না করতেই তারা বদলির তদবিরে ব্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে অভিভাবকদের মাঝেও শিক্ষার বিষয়ে নেই সচেতনতা।
দ্বীপের ক্যাম্প পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে আবদুল করিম (১৬), তাহারা বেগম (৮) ও মোহাম্মদ হোসেন (৬) কখনোই বিদ্যালয়ে যায়নি।
বিদ্যালয় কী, সেখানে কী হয় এ সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই এই শিশুদের। খেলার সাথীদেরকেও ওরা কখনো বিদ্যালয়ে যেতে দেখেনি।
তিন শিশুর মা ফরিদা বেগম বললেন, তিন বেলা খাবার যোগাড় করাই সমস্যা, তার উপর পানি উঠলে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে থাকারও জায়গা পাওয়া যায়না। এত সমস্যার মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারি না।

undefined
সহায় সম্পদ সব হারিয়ে বাড়ির ভিটেটুকু আঁকড়ে ধরে আছেন ফরিদা বেগম। এত সমস্যার মাঝে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা তার মাথায় আসেনা।
শুধু করিম, তাহারা ও হোসেনেরই অবস্থাই এমন নয়। দ্বীপের নাফ নদীর তীরে গিয়ে এরকম অসংখ্য শিশুর দেখা মেলে। কেউ নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত, কেউবা ব্যস্ত জাল গোছাতে।
৬-৭ বছর বয়স থেকে শুরু হয় বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া। অনেকে আবার ১০-১২ বয়সেই সব কাজ শিখে নিজেই কাজের নেতৃত্ব দেয়।
তবে শুধু নৌকা বাওয়া বা মাছ ধরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই দ্বীপের এসব শিশুর কাজ। দ্বীপের সবখানেই কর্মজীবী শিশুদের সঙ্গে দেখা মেলে। শুঁটকি তৈরি, পানি টানা, রিক্সা চালানো এবং মাঠে কাজ করে এসব শিশু।

undefined
এই চিত্র দেখে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের প্রায় শতভাগ উপস্থিতির ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় জনমনে।
শাহপরীর দ্বীপের অধিকাংশ অভিভাবকরা লেখাপাড়া শিখানোর চেয়ে ছেলেমেয়েদের কাজে পাঠানোকেই বেশি লাভজনক মনে করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, দ্বীপে নতুন ভবনসহ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে সমস্যার শেষ নেই।
শিক্ষক সংকট নিরসন কিংবা অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা না বাড়িয়ে শুধু ভবন তৈরিই যে সমস্যার সমাধান নয়, তারই প্রমাণ মিলল এই দ্বীপে। এখানকার চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলোতেই শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে।
বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ করেন দ্বীপের কয়েকজন অভিভাবক। তারা বলেন, বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকে না। ছেলেমেয়েদের প্রতি শিক্ষকের নজর থাকে না। এর ফলে অনেক অভিভাবক বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

undefined
শাহ পরীর দ্বীপের একটি বিদ্যালয় জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ৬টি পদ থাকলেও শিক্ষক আছেন দুই জন। এর মধ্যে একজন বদলি হয়ে যাওয়ার পথে। আরেকজন নতুন এসেছেন।
এছাড়া শিক্ষক স্বল্পতার কারণে এলাকা থেকে একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের তিনশ’ ১৭ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে চলছে।
এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল-আমীন গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এখানে যোগদান করেছেন। তার বাড়ি পাবনা জেলায়। এখানে থাকা খাওয়ার সমস্যার কারণে তিনিও অপেক্ষায় রয়েছেন কবে বদলির সুযোগটা আসবে।
আল-আমীন বলেন, শহরের ছেলেমেয়েদের পেছনে অভিভাবকেরা যে পরিমাণ সময় দেন, এখানে সেটা নেই বললেই চলে। ওরা বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলে যাচ্ছে কি না তা দেখার কেউ নেই।

undefined
দূরের শিক্ষকেরা এখানে এসে বেশিদিন থাকেন না এটা ঠিক, তবে অভিভাবকদের সচেতনতাও জরুরি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উন্নয়নে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন আল আমীন।
এতো গেল দ্বীপের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা। কোনভাবে প্রাথমিকের গন্ডি পেরোলেও অনেকের পক্ষেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়া সম্ভব হয় না। এ দ্বীপে একটি মাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অনেকেই সেখানে যেতে পারে না। ফলে প্রাথমিক স্তরেই আটকে থাকে এখানকার শিশুদের লেখাপড়া।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com]
বাংলাদেশ সময়: ০২৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৬