ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

মহেশখালীর আনন্দস্কুল, ঝরেপড়ার হার ৮০ শতাংশ

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৫
মহেশখালীর আনন্দস্কুল, ঝরেপড়ার হার ৮০ শতাংশ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: ২০১০ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী। এদের মধ্য থেকে ২০১৪ সালে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে মাত্র দুই হাজার।



এ হিসাবে প্রথম থেকে পঞ্চমে আসতে পারেনি ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী।

এটা কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর আনন্দস্কুলের চিত্র। মূলধারার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ফেরাতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে এই আনন্দস্কুল পরিচালিত হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে।

সরেজমিন দেখে মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় আনন্দস্কুল অনুসন্ধানে ব্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চোখে পড়েছে। এ কারণে স্কুল ও শিক্ষার্থী সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমেছে।

স্কুলে ভর্তি হয়েও অনেক ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি। বহু অভিভাবকের কাছে বৃত্তির টাকা পৌঁছেনি। স্কুলের জন্য ঘরভাড়া নেওয়া হলেও বহু ঘরের মালিক পায়নি ভাড়ার টাকা। এমন অসংখ্য অনিয়মের তথ্য মেলে।

সূত্র বলছে, মহেশখালীর বেশকিছু আনন্দস্কুল নামেমাত্র থাকলেও শেষপর্যন্ত ছাত্রশূন্য হয়ে পড়ে। স্কুলের জন্য ঘরভাড়া দিয়ে অনেকেই ঘরের ভাড়া পাননি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এমন বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। নীতিমালা অনুযা‍য়ী, ঘরের মালিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

উপজেলা সদরের কাছে চরপাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডে আনন্দস্কুলের ঘরের মালিক জুলেখা বেগম ঘরের ভাড়া পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।

তিনি জানান, ঘরের ভাড়া নির্ধারণ করে কোনো চুক্তি করা হয়নি। ভাড়া বাবদ কোনো টাকা পয়সাও পাননি তিনি। এই অভিযোগে তিনি আবেদন করেছেন মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে।
 

স্কুলে ভর্তি হয়েও অনেক ছাত্রছাত্রী উপবৃত্তির টাকা পায়নি। আবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি। এমন অভিযোগ চরপাড়া গ্রামের অনেকের।

আনন্দস্কুলের ছাত্র আজিমুলের মা মোমেনা বেগম অভিযোগ করেন, তার ছেলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল। পাঁচ বছর পূর্ণ করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও পেয়েছে। কিন্তু এই সময়ে উপবৃত্তির টাকা পেয়েছে মাত্র আটশ।

চরপাড়ার হেলাল উদ্দিন, বাবা ফরিদ আলম। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রবেশপত্র পর্যন্ত পেয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়নি।

হেলালের মা মোতাহারা বেগম বলেন, ছেলে ভর্তির পর ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট হয়েছে। প্রথম বছর উপবৃত্তির ছয়শ টাকা ব্যাংক থেকেই তুলে এনেছেন। কিন্তু এরপরে ১/২শ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপরও পরীক্ষা দিতে না পারার কোনো কারণ জানেন না তিনি।

আনন্দস্কুলের ছাত্র হেলাল উদ্দিন পৌরসভার শহিদুল্লাহর বাড়ির আনন্দস্কুলের ছাত্র ছিল। তার কাছে স্কুলের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সে জানালো, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির সময় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ২৭-২৮ জন। এই সংখ্যা কমে এসে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১০-১২, তৃতীয় শ্রেণীতে ১০-১২, চতুর্থ শ্রেণীতে ৭-৮ এবং পঞ্চমে এসে ৬-৭ জনে পৌঁছায়।

ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আরো অনেক শিক্ষার্থী একই স্বীকারোক্তি দেয়।
 
সুমি আকতার। বাবা মৃত আবদুর রহমান। পৌরসভার জালাল আহমেদ বাড়ির আনন্দস্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। প্রথম শ্রেণী থেকে আনন্দস্কুলে পড়াশুনা করলেও পাঁচবছরে উপবৃত্তির একটি টাকাও মেলেনি। শেষপর্যন্ত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও পায়নি।

সুমির মা ফাতেমা বেগম বলেন, টাকার অভাবে মেয়েকে পড়াতে পারছিলাম না। অনেক আশা নিয়ে আনন্দস্কুলে ভর্তি করেছিলাম।

আনন্দস্কুল নিয়ে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেও রয়েছে নানামুখী প্রশ্ন। অনেকেই বলেছেন, ঝরেপড়া ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ফেরাতে সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিলেও এর বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এর ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও সাফল্য মিলেছে সামান্যই।

মূলধারার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক বললেন, প্রয়োজন নেই এমন সব স্থানে স্কুল করা হয়েছে। আবার ছাত্রছাত্রীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বহু নাম। ‍

মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থাপনায় ছিল ব্যাপক অনিয়ম। কোথাও আনন্দস্কুল স্থাপনের আগে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নেওয়া হয়নি।

আবার শিক্ষার্থী না থাকায় অনেক সময় আনন্দস্কুলে কেউ পরিদর্শনে এলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছাত্র দেখানো হয়।
       
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সালে শুরুর সময়কালে গোটা উপজেলায় ৩৩৪টি আনন্দস্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। ২০১৪ সালের প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় দেখা যায়, স্কুলের সংখ্যা কমে ২৫৪ এবং ছাত্রছাত্রী কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ হাজারে।        

আনন্দস্কুল মহেশখালীর দায়িত্বে থাকা প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী (টিসি) আবদুল লতিফ বলেন, আনন্দস্কুল প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথমদিকে কিছু সমস্যা ছিল। প্রথমে এটি বাস্তবায়নে এনজিও নিয়োগ করা হয়েছিল। পরে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় সরকার। প্রথমদিকে অতিরিক্ত স্কুল ও ছাত্রছাত্রী তালিকাভুক্ত করায় শেষদিকে এর বিরূপ প্রভাব দেখা গেছে।
 
তিনি বলেন, মহেশখালী উপজেলার বেশকিছু এলাকা অত্যন্ত দুর্গম। এলাকার মানুষ অনেক অসচেতন। এই এলাকার বসবাস করেন জেলে ও লবণচাষি। এদের অনেকেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে পাঠানোকে এখনও লাভজনক মনে করেন।

এর ওপর প্রকল্প বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এইসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে সেসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে আমাদের চেষ্টাও ছিল।
 
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশীষ চিরান বলেন, আনন্দস্কুলের কার্যক্রম বাস্তবায়নে বেশকিছু সমস্যা ছিল। প্রথমে এনজিওদের দায়িত্ব দেওয়ায় কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া লোকবলের সংকটও ছিল ব্যাপক। এসব সমস্যার ভেতর দিয়ে শতভাগ না হলেও এই কর্মসূচি অন্তত ৭০ ভাগ সফল হয়েছে।
  

প্রসঙ্গত, প্রাথমিকে ঝরেপড়ার হার কমাতে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে আনন্দস্কুল প্রকল্প শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। মহেশখালীসহ পিছিয়ে থাকা ৩০ উপজেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। প্রথমে এই প্রকল্প এনজিওদের বাস্তবায়িত হলেও পরে সরকারের সরাসরি তদারকিতে আনা হয়।
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়:[email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০৩০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।