ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

টাকা ছাড়া তারা ‘কাঠের পুতুল’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৪ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৬
টাকা ছাড়া তারা ‘কাঠের পুতুল’

হাতিয়া দ্বীপ থেকে: টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে- প্রচলিত প্রবাদ। কিন্তু নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের একমাত্র সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের ক্ষেত্রে বলা চলে, টাকা ছাড়া তারা কর্তব্যজ্ঞানহীন, কাঠের পুতুল মাত্র।

প্রায় সাড়ে চার লাখেরও বেশি জনসংখ্যার দ্বীপ হাতিয়ায় হাসপাতাল বলতে এই সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই ভরসা। যেখানে ফ্রি চিকিৎসা পাওয়ার কথা, সেখানে টাকা না দিলে চিকিৎসকরা রোগীর ছায়াও মাড়ান না বলে অভিযোগ রয়েছে।

হাতিয়ার উপজেলা পরিষদের ঠিক উল্টো পাশে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালটি ঘুরে কর্মচারী ও ডাক্তাররা কীভাবে চিকিৎসার অধিকারকে টাকার কাছে জিম্মি করে ফেলেছে, সেই চিত্র পাওয়া যায়।

পরিচ্ছন্নতা কর্মী থেকে ডাক্তার, টাকা ছাড়া কাজ করেন না কেউই। এমনকি জরুরি বিভাগে রোগীরাও নগদ অর্থ ছাড়া চিকিৎসা পান না। অবহেলায় গর্ভবতী নারীর সন্তান মারা যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

বুধবার জন্মের পরেই জ্বরে আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে মেঝেতেই রাত কাটাতে হয় রোকসানা ও বাহারউদ্দিন দম্পত্তিকে। হাসপাতালের বিছানা ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও রাতের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীকে মাত্র দু’শ টাকা বকশিশ না দেওয়ায় পৃথিবীতে এসেই এই নিমর্মমতার শিকার হতে হয় ওই নবজাতককে।

শুধু তাই নয় রাতভর ক্রন্দনরত শিশুটির চিকিৎসায় বারবার ডাকার পরেও কোনো চিকিৎসব কিংবা নার্সের দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ করেন শিশুটির বাবা বাহারউদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই আমার বাচ্চাটির জ্বর। সারাক্ষণ কাঁদছিল সে। অথচ অনেক ডাকাডাকি করেও নার্স কিংবা ডাক্তারের দেখা মেলেনি। রাতে ডাক্তার থাকে না। শেষ রাতে দু’শ টাকার বিনিময়ে একজন নার্স আসে, কিন্তু কোনো ওষুধ দেননি। পরদিন দুপরে একজন ডাক্তার এসে ওষুধ লিখে দেন। আমি বাইরে থেকে সেসব ওষুধ কিনে আনি। শিশুটিকে ইনজেকশন দেওয়ার দু’শ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত হাতে ক্যানাল লাগাননি নার্স। ’
সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া আরেক হতদরিদ্র মা পলি। রিকশাচালকের এই স্ত্রীকে গর্ভকালীন জটিলতার কারণে দুইবার হাসপাতালে আনা হয়। তবে ডাক্তারদের টাকা না দিতে পারায় বিনা চিকিৎসায় ফিরেও যেতে হয়। পরে গ্রামের মেম্বারদের সুপারিশে তৃতীয়বারে তাকে ভর্তি করিয়ে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে সন্তান ভূমিষ্ট করানো হয়। তবে একটি স্যালাইন ছাড়া কোনো ওষুধ মেলেনি।

টাকার লোভ শুক্রবার কেড়ে নিয়েছে কাউসার-রেশমা দম্পত্তির নবজাতকের প্রাণ। হাসপাতালের গেটে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা কাউসার বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রসব বেদনা ওঠায় স্ত্রীকে বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করাই। অ্যানেসথেশিয়ার ডাক্তার না থাকায় হাসপাতালেরই আরেক ডাক্তার শহীদুল ইসলাম চৌধুরী সৈকতকে ডেকে আনি। তিনি দুই হাজার টাকা না পেলে অ্যানেসথেশিয়া করাবেন না বলে জানিয়ে দেন। ’

‘কয়েক ঘণ্টা ধরে অনেক আকুতি মিনতির পরেও তার মন গলেনি। অবশেষে এক হাজার টাকায় দফা হলে আমার স্ত্রীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ছেলের জন্ম হয়। অপারেশনে দেরি হওয়ায় নবজাতকের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। দ্রুত তাকে নোয়াখালীর মাইজদী হাসপাতালে নিতে বলা হয়। ট্রলারে করে নেওয়ার পথেই আমার প্রথম সন্তান অভিমানে পৃথিবী ছাড়ে’- আর্তনাদ করে বলেন হতভাগ্য পিতা কাউসার।

এ অভিযোগ প্রসঙ্গে ডা. সৈকত বীরদর্পে টাকা নেওয়ার কথা বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করে বলেন, ‘আমি তখন ডিউটিতে ছিলাম না। আমাকে বাসা থেকে ডেকে আনা হয়। অবসরে আমি ফি চাইতেই পারি!’

হাসপাতালের এসব অনিয়ম সম্পর্তে জানতে চাইলে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, টাকা নেওয়ার কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।   এখানে ফ্রি ওষুধ দেওয়ার নিয়ম। তবে ওষুধ স্বল্পতা থাকলে আমরা রোগীকে প্রেসক্রিপশন দেই। তারা বাইরে থেকে আনেন। তবে সেটার পরিমাণ কম।

চিকিৎসকসহ হাসপাতালের লোকবল কম থাকায় চিকিৎসা সেবা দিতে অসুবিধা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৭ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৬
জেপি/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।