ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূলে

‘বুড়ো গৌরাঙ্গ’ নদীর মাঝি

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৬
 ‘বুড়ো গৌরাঙ্গ’ নদীর মাঝি

উপকূল থেকে ফিরে: নাম তার শাকিল। বয়স ১৩।

রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে বুড়ো গৌরাঙ্গ নদীতে নৌক‍া চালাতে চালাতে গায়ের রঙটা কেমন ফ্যাকাশে করে ফেলেছে। মাথার চুল হয়েছে তামার বর্ণ। ফিনফিনে শরীরেই তার অদম্য শক্তি। সেই শক্তি দিয়েই দুর্যোগের দিনে উত্তাল নদীর বুকে বৈঠার ‘ঘাই’ মারতে মারতে শাকিল বলছিল-‘পানির আইজ মাথা গরম’।
 
পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালি উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ‘চর কাসেম’। এই চরেই বসবাস শাকিলের। মূল ভ‍ূখন্দের সঙ্গে চরের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে শাকিলের ছোট্ট খেয়া নৌকা। সকাল ৬টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এই কাজ করে চরম নিষ্ঠার সঙ্গে।
 
যখন ‘গাঙ্গি পাড়া’ খেয়া ঘাটে গিয়ে পৌছাই, তখন সময় বিকেল সাড়ে চারটা। ঘুর্ণিঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্র ঘোষিত তিন নম্বর সতর্ক সংকেত চলছিল। সাগর ও নদী থেকে এরইমধ্যে সকল মাছ ধরা ট্রলার ও নৌযান নিরাপদ স্থানে ফিরে এসেছে। স্থানীয় নৌযান চলাচল কর্তৃপক্ষ বন্ধ করেছে সব ধরনের নৌ পারাপার। কিন্তু বন্ধ হয়নি, শাকিলের খেয়া। টানা বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে উত্তাল নদীতে সে পারাপার অব্যাহত রেখেছে।
 
বড় ঢেউ যখন ছোট নৌকাকে বেপথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন শাকিল প্রাণপনে চেষ্টা করছিলো গতিপথ ঠিক রাখতে। এমন সময় তার দিকে তাকাতেই বিজ্ঞের মতো অভয় দিয়ে বলল- ‘ডরাইয়েন না। পানির আইজ মাথা গরম। ’ ভয় পাইনি ঠিকই, তবুও ভাবতে হয়েছে কিশোর এই মাঝিকে নিয়ে। কি অসীম সাহস আর শক্তি ছোট্ট শরীরের ভেতর। চোখে মুখে সারাক্ষণ হাসির ছটা!
 
সন্ধা তখন ঘন হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বৃষ্টির ছটাও। মাইল দুরের সাগর থেকে জোরে বইছে লোনা বাতাসও। এরইমধ্যে আবার ফিরে এলাম খেয়া ঘাটে। এবার আমাদের সঙ্গী আরো কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। তারা সবাই ভূমীহীন কৃষি শ্রমিক। বসবাস নদীর পাড়ের বেড়ি বাঁধে। চর কাসেমে এখন আমন চাষের ভরা মৌসুম। সে কাজেই প্রতিদিন তারা এপার ওপার হচ্ছেন।

 
এদেরই একজন গোলাম হোসেন হাওলাদার। পরিচয় জেনে বলছিলেন, ‘ঢোপার দিনে (বর্ষার দিনে) চরাঞ্চলের মানুষের জীবন মৃত্যুর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। যেমন এই ঘাটে আগে খেয়া বাইতেন বাতেন মাঝি। শাকিলের দাদা। মাস তিনেক আগে ঢেউয়ের তোড়ে তার খেয়া ভেঙ্গে তক্তা হয়ে যায়। পাওয়া যায়নি বাতেনকেও। সেই থেকে খেয়া বাওয়ার কাজ নিয়েছে শাকিল’।
 
যখন এই আলাপ হচ্ছিল তখন শাকিলও মশকরায় ব্যাস্ত মৃত দাদাকে নিয়ে। বলছিল- ‘বুড়ো বোকা ছিল। সাতাঁর দিতে পারলো না!’ জানতে চাইলাম তার ভয় করেনা? তার জবাবটাও দিলো আনমনে বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে- ‘মোরা চরের মানু, মোগো ডরাইলে চলেনা। সবই পারতে অয়’।
 
সহযাত্রী গোলাম হোসেন জানান, এখানকার প্রায় সবগুলো পরিবারেই ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর নৌকাডুবিতে দুই-চারজন করে স্বজন হারানোর স্মৃতি আছে। তাই ডরায় না কেউই। এইসব দুর্যোগ মোকাবেলা করেই চলে চরের জীবন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৬
আরএম/বিএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।