ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

নদীতেই জীবন-জীবিকা, নদীতেই মরণ!

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৯ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৭
 নদীতেই জীবন-জীবিকা, নদীতেই মরণ! নদীতেই জীবন-জীবিকা -ছবি- বাংলানিউজ

ভোলা: ‘ আমাদের খবর নিয়া কি করবেন? কেউ কি আমাদের খবর রাখে?’- বলছিলেন মানতা বধূ নূরজাহান (২২)।

নদীর তীরে নৌকার মধ্যেই রান্না করছিলেন তিনি। চোখে-মুখে কিছুটা চিন্তা আর আতঙ্কের ছাপ।

মুখে হাসি নেই, জীবন-জীবিকার টেনশনে।  

নূরজাহান বাংলানিউজকে বলেন, ‘নদী আমাগো জীবন, এই নদীই আবার আমাগো সবার মরণ। নদীতে মাছ ধইরা যেমন খাবার জুটে, হেই নদীতেই আবার সন্তানদের মৃত্যু হয়। বহু চেষ্টা করি, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু কখনও কখনও পানিতে ডুবে মারা যায়। অনেক সময় মরদেহ খুঁজেও পাওয়া যায় না’।

ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকায় দেখা মেলে বানভাসি মানতা সম্প্রদায়ের নৌকা বহর।  

দু:সাহসী মানতা নারী নূরজাহান জীবন সংগ্রাম আর কষ্টের গল্প  তুলে ধরে বলেন, ‘এক বছর আগে আমার একমাত্র সন্তান পানিতে পড়ে মারা যায়। সেই থেকে কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু তবুও পানিতেই বাস করতে হবে। এতো সতর্ক থাকি,  তবুও বাঁচাতে পারিনি তাকে।  

জীবন-জীবিকার তাগিদে পানির ওপরে নৌকায় বসবাসকারী মানতা সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা ঠিক এমনই। নৌকার মাঝে সুখ-হাসি-আনন্দ খুঁজে পেলেও হারানোর বিয়োগ ব্যথায় কাঁদতেও হয় তাদের।

নদীতেই জীবন-জীবিকা -ছবি- বাংলানিউজঅবহেলিত-বঞ্চিত এসব মানুষ নদীতে সারাদিন জাল বুনে মাছ শিকার করেন। ওই মাছ স্থানীয় মাছ ঘাটে বিক্রি করে খাবারের ব্যবস্থা করেন। নৌকাতেই ঘর-সংসার তাদের, একমাত্র সহায়-সম্বলও। স্বাভাবিক জীবন থেকে আলাদা জীবনযুদ্ধে তাদের সঙ্গীও কেবল নৌকা আর জাল।  

নৌকায় বসবাস করতে গিয়ে কখনও কখনও তাদের হারাতে হয় ছোট ছোট শিশু সন্তানদের।

মানতা সর্দার আলমগীর বলেন, কিছুদিন আগে বাদশা  ও মিন্টুর দু’টি মেয়ে নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। গত এক বছরেই বহরের ১০টি শিশু মারা গেছে। কঠিন জীবনযুদ্ধের মাঝেও সন্তানদের কথা মনে করে আজো কাঁদেন তারা।  

মানতা সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা জানান, মানতাদের নিজস্ব সম্পত্তি নেই। নেই নিজস্ব বসতি কিংবা ঘর-দুয়ার। নৌকাতেই তাদের বসবাস। গোসল, রান্না-বান্না, বিয়ে, সন্তান লালন পালন, মাছ শিকারও চলে নৌকাতেই।  

নৌকা বহর নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাদের ছুটতে হয়। কখনও কখনও ঝড়ের সঙ্গে লড়াই, আবার কখনখও জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয়। জীবনের নিরাপত্তা না থাকলেও নৌকাতেই চলে বসতি।  

প্রকৃতির বৈরি আবহাওয়া উপেক্ষা করে আবার নদীতে মাছ শিকারও করতে হয় তাদের। মাছ ধরা না পড়লে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটাতে হয়।  

মানতা সর্দার জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাদের ঘর-ভিটে নেই। নদীতেই বসবাস করি। সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পাইনি। শিক্ষা-চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত আমরা’।  

মানতা বধূ কোহিনুর জানান, ছোটবেলা থেকে নৌকাতেই বড় হয়েছেন তিনি। পরে নৌকার বহরে বিয়ে হয়, সেই নৌকাতেই এখন সংসার জীবন তার। এখন সন্তানদের বড় করছেন। এক সময় তাদেরও বিয়ে দেওয়া হবে নৌকাতেই।

নূরজাহান বলেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু ফেরার কোনো উপায় নেই। নৌকায় জড়িয়ে রয়েছে জীবন-জীবিকা। এক সময় নৌকাতে শেষও হবে এ জীবন।  

ভোলার জেলা প্রশাসক মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘মানতাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই। তবে প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্লিনিক কিংবা মেডিকেল টিমে এসে সুবিধা নিতে পারবেন তারা। তারা এলে বা নজরে পড়লে আমরা অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করবো। বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলোকেও নির্দেশনা দিয়েছি,  যেন তারা বঞ্চিত মানুষদের  সহযোগিতা করে’।  

বাংলাদেশ সময়: ০২৩০ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।