ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

দুঃখ-কষ্টে ভরা জলদাসদের জীবনগাঁথা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
দুঃখ-কষ্টে ভরা জলদাসদের জীবনগাঁথা শীতকাল হওয়ায় নদীতে মাছ নেই। তাই অলস সময় কাটছে জলদাসদের-ছবি-বাংলানিউজ

সোনাগাজী (ফেনী) উপকূল থেকে ফিরে: কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, আর হাল জামানার লেখক হরিশংকর জলদাসের ‘জলদাসীর গল্প’ এসব বইতে মৎস্যজীবী নানা চরিত্রের রূপায়ণ দেখি।

এমন আরও হাজারো চরিত্র বিরাজ করছে নদী তীরের জলদাস সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাদের জীবন সমাজে বসববাসরত অন্য সাধারণদের মতো নয়, নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে জীবন পার করেন তারা।

বৈষম্যের শিকার হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার সংগ্রামে তারা হয়েছেন বার বার পরাজিত। যার দেখা মিলবে কোনো একটি জলদাস পাড়ায় কিছুটা সময় কাটালেই।  

ফেনীর সোনাগাজী পৌর শহর থেকে মাইল চারেক দূরে সমুদ্র উপকূলে সোনাগাজী জলদাস পাড়া। সেখানে মৎস্যজীবীদের জীবন চলে নিজস্ব আদলে। সেখানে প্রাণ আছে, প্রাণবান পরিবেশ নেই। জীবন আছে, জীবনায়নের সুস্থির বাতাবরণ নেই।

জীবনাচার নিয়ে কথা হয় একাধিক পরিবারের সঙ্গে। আলাপে জানা যায়, এ পাড়ায় জলদাসদের বসবাস প্রায় অর্ধশত বছর ধরে। বাস করে প্রায় ২শ’ পরিবারে হাজারখানেক মানুষ।  

পাড়ায় একটিমাত্র পুকুর।  ময়লা আবর্জনা সত্ত্বেও সেই পুকুরেই সারতে হয় রোজকার সব কাজ-ছবি-বাংলানিউজমাঘের সকালে কুয়াশা ভেদ করে যখন আলো ফুটছিল তখন পাড়ার শেষ মাথার চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায় নানা বয়সীদের জটলা। ক্যামেরা দেখেই তারা বেশ উৎসাহিত হয়ে গল্প জমিয়ে দিলেন। কথা হয় মদন মোহন জলদাসের সঙ্গে। তিনি জানান, সারাজীবনই তাকে ঋণের বোঝা নিয়ে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে, অভাব যেন তাকে ছাড়ছে না।  

তিনি বলেন, নৌকা নিয়ে সাগরে যাওয়া বাপ-দাদার ব্যবসা, এছাড়া আর কিছুই জানা নেই। কষ্ট হলেও সাগরই একমাত্র অবলম্বন। আক্ষেপের সঙ্গে মদন বলেন, দরিয়াও এখন মুখ তুলে নিয়েছে। আগের মতো এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। তাই পরিবার নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটে।  

প্রিয় লাল নামের আরেক জলদাস জানান, শীতে সাগরে মাছ থাকে না। তাই ধারদেনা করে চলতে হয়। বর্ষায় মাছ থাকলেও তখন আতঙ্কে থাকতে হয় ঝড়-সাইক্লোনের। আবার ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়ে মেলে না চাহিদামত সহযোগিতা।  

কথা হয় গোবর্ধন জলদাসের সঙ্গে। তিনি পেশায় নৌকার কারিগর। তিনিও একসময় মাছ ধরতেন। সাগরে মাছ না থাকায় এখন মাছ ধরা বাদ দিয়েছেন।  

পাড়ার দোকানে সদাই করতে আসা পূর্ণিমা জলদাস জানান, ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে বাবার বাড়ি থেকে এসেছেন এ পাড়ায়। বয়স এখন ৬০ ছুঁই ছুঁই। জানালেন, অভাবের কারণে মেয়ে মনিকা, ছেলে সাগর ও বৃন্দাবন কাউকেই পড়ালেখা করানো সম্ভব হয়নি।  

কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে ভাঙাচোরা ঘরেই চলছে গৃহস্তের কাজ-ছবি-বাংলানিউজসুরঞ্জন, সবীর ও জুয়েলরা জানান, দরিয়ায় এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। আগে ১ ঘণ্টায় যে মাছ পাওয়া যেত এখন সারাদিনেও তা পাওয়া যায় না।  

পাড়াটি ঘুরে দেখা গেছে, শুধু অভাব নয়- তারা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার থেকে। পুরো পাড়াতে কয়েকশ’ শিশু থাকলেও তাদের জন্য কোনো স্কুল নেই। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে স্কুলে গিয়ে পড়তে চায় না শিশুরা। তাই স্কুলে না গিয়ে সাগরে মাছ ধরতেই কাজে লেগে পড়ে তারা।  

অপরদিকে চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছরই মরতে হয় কাউকে না কাউকে। তারা জানান, পাড়ার পাশে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেখানে ডাক্তার নেই। উপজেলা সদরে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার পেলেও টাকা ছাড়া ওষুধ মেলে না। তাই বিনা চিকিৎসাতেই মরতে হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৭ 
এসএইচডি/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।