ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জীবন-জীবিকা

সারাদিন শুঁটকি বাইছা ২শ টাহা পাই!

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫১ ঘণ্টা, জুন ১, ২০২০
সারাদিন শুঁটকি বাইছা ২শ টাহা পাই! শুঁটকি বাছাই করছেন নারী শ্রমিকরা। ছবি: বাংলানিউজ

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় বাসিন্দাদের জীবন চলে অতি কষ্টে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগের সঙ্গে তাদের বসবাস। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকে উপকূলবাসী। উপকূলবাসীর অন্তহীন দুর্দশা এবং জীবন-জীবিকার চিত্র নিয়ে পাথরঘাটা উপজেলা করেসপন্ডেন্ট শফিকুল ইসলাম খোকনের প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব।

বিহঙ্গদ্বীপ সংলগ্ন রুহিতার শুঁটকি পল্লি থেকে ফিরে: ‘আরে স্যার মোগো ছবি তোলেন, ছবি তুইল্যা কি হরবেন। এ রহমের কতো লোকে যে কত ছবি তুইল্যা নেলে কোনো কামের কাম তো দেহি না।

মোগো কতা কেউ ভাবে না, মেগো কেউ জিগায়ও না। ’

বাংলানিউজের এ প্রতিবেদক ছবি তুলতে গেলে এসব কথা বলেন বিহঙ্গদ্বীপ সংলগ্ন শুঁটকি পল্লির শ্রমিক খাদিজা বেগম।

তিনি বলেন, মোগো জন্ম হইছে কষ্টের কপাল নিয়া। ছবি তুইল্যা মোগো কপালের পরিবর্তন আনতে পারবেন না। এতো কষ্ট করি, মোরা সরকারি সহযোগিতাও পাই না, মেম্বর-চেয়ারম্যানরা সব খাইয়া ফালায়। মোগো দেখার কেউ নাই। পোলাডারে লইয়া কোনো রহম দিন কাটাই।

বিশ্বঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ঘেঁষা বলেশ্বর নদ, তার পাশেই উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটা। বলেশ্বর, বিষখালী নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর মাঝখানেই পাথরঘাটা উপজেলা। এখানকার অধিকাংশ মানুষ খেটে খাওয়া দিনমজুর এবং মৎস্য পেশার ওপর নির্ভরশীল। উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার মানুষ সব সময়ই দুর্যোগের সঙ্গে আলিঙ্গন করেই বসবাস করে। সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, ফণি, বুলবুল, আম্পান। সব কিছুই যেন তাদের জীবনসঙ্গী।

সরেজমিনে পাথরঘাটা উপজেলার সদর পাথরঘাটা ইউনিয়নের বিহঙ্গদ্বীপ সংলগ্ন রুহিতা গ্রাম। যেখানের বাসিন্দাদের কাজ মাছ শিকার, মাছ বাছাই ও শুঁটকি তৈরি করা। এসব কাজ করেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা। এখানকার অনেক নারীরা মাছ শুকানো ও বাছাই করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরুষের সঙ্গে সমান অংশে কাজ করলেও এখনো বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকরা।

কথা হয় স্বামী পরিত্যক্তা খাদিজা বেগম, ফাতেমা বেগম, ফিরোজা বেগম, পারভীন বেগমের সঙ্গে। তাদের নেই কোনো জমি, সরকারি জমিতেই পূর্ব পুরুষ থেকে বসবাস করছেন। খাদিজা, ফাতেমার মতো নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমান অংশে কাজ করছেন। কখনো নদীর পাড়ে ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরা, আবার কখনো মাছ শুকানো থেকে শুরু করে মাছ বাছাই করছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে আজও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ২শ টাকা পাচ্ছেন।

খাদিজা বেগম জানান, ২২ বছর আগে স্বামী ফেলে রেখে চলে গেছেন। একমাত্র ছেলে নিয়ে হাড়ভাঙা কাজ করছেন। টাকার অভাবে ছেলেকে লেখাপড়াও করাতে পারেননি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খালে, বিলে নদীর পাড়ে মাছ ধরে সংসারের চাহিদা মেটান।

খাদিজা বেগম বলেন, ২২ বছর ধইর্যা কাজ করি। শুঁটকির সিজনে মাছ বাইছ্যা পাই ২০০ টাকা। কাঁচা মাছ বাইছ্যাও পাই ১ থেকে ১৫০ টাকা। হেইয়্যা দিয়া পোলাডারে লইয়া খাই।  

কথা হয় আরেক নারী শ্রমিক ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক মাইয়া আর দুই পোলা লইয়া থাহি। স্বামী সোহরাব বহুদিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারে না। মুই মাছ বাছি, মাছ ধইর্যা যা পাই তা দিয়া সংসার চালাই।

খাদিজা, ফাতেমার মতো ফিরোজা, পারভীনসহ অনেক নারী এই কাজ করেন। শুঁটকি পল্লিতে নারীরা অগ্রাধিকার হিসেবে কাজের সুযোগ পেলেও পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না সে রকম।

এ বিষয় শুঁটকির মালিক সাবেক ইউপি সদস্য শাহ আলম বলেন, আমাদের যেভাবে উপার্জন হয় তার উপরেই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেই।

তাদের কোনো রকম বঞ্চিত করা হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।

নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের পাথরঘাটা উপজেলা ব্যবস্থাপক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে পাথরঘাটায় নারী শ্রমিকদের শ্রম ভিন্নতা রয়েছে। আমরা তাদের অধিকার এবং পারিশ্রমিকের বিষয়ে এলাকাভিত্তিক সচেতনামূলক কাজ করেছি কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন হলেও আশানুরূপ পরিবর্তন এখনো হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫১ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।