ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উড়িরচরের জীবন যেমন (তৃতীয় পর্ব)

শিক্ষার আলো নিভু নিভু!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২২
শিক্ষার আলো নিভু নিভু! উড়িরচরের শিক্ষার্থীরা

উড়িরচর (চট্টগ্রাম/নোয়াখালী) থেকে ফিরে: সাগর-নদীর অবারিত জলরাশি বেষ্টিত ছোট্ট জনপদ উড়িরচর। জোয়ার-ভাটায় তাল মিলিয়ে চলে এখানকার জীবন।

১৯৮৫ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলার মতো বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই টিকে আছে এ চরের লড়াকু মানুষ। অতীতে দস্যুদের রাজত্ব থাকলেও এখন ফিরেছে শান্তি, অন্ধকার চরে জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি।

সুদিন ফিরলেও সংকট এখনও অনেক। চারদিকেই পানি হওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, দুই জেলার মধ্যে সীমানা বিরোধ ও নদী ভাঙনের মতো সমস্যা টেনে ধরেছে চরের অগ্রগতি। ধান, সবজি, মাছ ও কাঁকড়ায় সমৃদ্ধ এই চরের বর্তমান চিত্র দেখে এসে লিখেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম। ৬ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্বে থাকছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সংকটের কথা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের লগ্ন ছুঁতে চললেও সূর্যের খরতাপ একটুও কমেনি, চামড়া পোড়া রোদ। যেন কার্তিকের হেমন্তে গ্রীষ্মের গরম। দ্বীপে মোটরসাইকেল ছাড়া চলাচলের তেমন বাহন নেই। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চর লক্ষ্মী ট্রলারঘাট থেকে নেমে আমাদের গন্তব্য কলোনিবাজার। মাঝ পথে উড়িরচর পুলিশ ফাঁড়ি পার হতে গিয়ে একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেলো। প্রখর এই রোদে রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে হাঁটছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এ দলে দুই/একজন ছেলে থাকলেও অধিকাংশই মেয়ে।

মোটরসাইকেল থেকে নেমে কথা বলতে চাইলাম কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। হাতে ছবি তোলার যন্ত্র দেখে কথা বলতে চাইলো না অনেকে। শেষে শ্যাম বর্ণের হালকা গড়নের এক কিশোরী কথা বলতে রাজি হলো। তাকে বেশ ছটফটেই মনে হলো। কথা বলে জানা গেলো নাম শারমিন। প্রতিদিন ৪ মাইল হেঁটে উড়িরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আসে সে। ষষ্ঠ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী স্কুল শেষে আবার ৪ মাইল হেঁটেই বাড়ি ফেরে। উড়িরচরে শিক্ষার সংকট এমনই প্রকট। এখানে মাধ্যমিক স্কুল সাকুল্যে একটি। পাঠদানের অনুমতি আছে তাও অষ্টম পর্যন্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র চারটি।



আরেকটু পথ এগোতেই চোখে পড়লো স্কুলটির নামফলক। ভাবলাম স্কুলটা দেখে আসা দরকার। ভ্রমণসঙ্গীরাও সাড়া দিলেন। রাস্তা থেকে ২০/২৫ মিটার দূরেই স্কুলটি। প্রথমেই চোখে পড়লো চৌচালা একটি টিনের জরাজীর্ণ ঘরের দেওয়ালে সাঁটানো স্কুলের নামফলক। স্থানীয় একজন জানালেন স্কুলের পাঠদান চলে আশ্রয়েন্দ্রের ভবনে। উচ্চ বিদ্যালয়ের এই টিনের ঘর আরেকটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের কাছে ভাড়া দেওয়া।

চরের স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল জানালেন, আশ্রয়কেন্দ্রের ভবনে গেলে ছাত্র-শিক্ষকের দেখা মিলবে। টিনশেডের ঘর পেরিয়ে এগিয়ে আশ্রয়ণের ভবনের নিচে যেতেই নাকে এলো রান্নার ঘ্রাণ। মনে হচ্ছিলো কোনো গৃহস্থবাড়িতে চলে এসেছি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলো না গৃহস্থবাড়ি নয়, এটি স্কুল। শিক্ষকরা দূর-দূরান্ত থেকে আসেন। দুপুরের খাবারের অসুবিধা হওয়ায় শিক্ষকরাই স্কুলে রান্না করেন। শ্রেণিকক্ষ এবং চারপাশের অবস্থা দেখেই বোঝা  যাচ্ছিল স্কুলটির দুরাবস্থা। ক্লাসগুলোতে এলোমেলো বেঞ্চ। শ্রেণিকক্ষগুলোতে পলিথিনের আবর্জনা।

কিছুক্ষণ পর এলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হাসান। বেশ আন্তরিকভাবে কথা বললেন। জানালেন স্কুলের নানা সংকটের বিষয়ে। জানালেন করোনার আগে স্কুলে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। এখন সেখানে শিক্ষার্থী সাকুল্যে দুইশো। জানালেন এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি আছে। শিগগিরই নবম শ্রেণির পাঠদানের অনুমতি মিলবে। মন্ত্রণালয়ে তা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রবীণ এ শিক্ষক জানালেন স্কুলের নিজস্ব জায়গা নেই। যে জমি আছে তা খাসজমি। নানা জটিলতায় স্কুলের অগ্রগতি থমকে আছে।



স্কুল থেকে বেরিয়ে কথা হয় আমাদের মোটরসাইকেল চালক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। সাইফুলকে প্রশ্ন করলাম পড়েছেন কতটুকু। তিনি হেসে বলছিলেন, ‘আমি চরের উচ্চ শিক্ষিত’। আদতে সাইফুল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এর বেশি সুযোগ হয়নি তার। স্কুলেরই পাঠদানের অনুমতি ছিল না এর চেয়ে বেশি।

সাইফুলের মতো এমন অনেকেই আছেন, যারা আরও একটু পড়াশোনা করতে চেয়েও পারেননি। একটু ভালো স্কুলে পড়তে হলে যেতে হয়ে নোয়াখালী কিংবা সন্দ্বীপ অথবা চট্টগ্রামে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দা নুর নবী রবিনের সঙ্গে। তিনি জানান, দিনভর কাজ, সন্ধ্যা হলে ঘুম, সকালে উঠে ফের চলে যায় ক্ষেতে— এটাই চরের মানুষের জীবন। এখানকার মানুষের খাবারের হয়তো অভাব নেই, দু’বেলা, দু’মুঠো ঠিক মতো খেতে পারে। তবে নগদ টাকা জমা নেই। তাই ছেলেমেয়েদের শিক্ষার পেছনে নগদ টাকা দিতে পারেন না অবিভাবকরা। চরে ৪টি সরকারি প্রাইমারি স্কুল থাকলেও সরকারি হাইস্কুল নেই। পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে, সেখানে ব্যয়ও বেশি। এছাড়া সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম বা নোয়াখালী গিয়ে পড়ার সামর্থ্য না থাকার কারণে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকছে এখানকার মানুষেরা।



দ্বীপের বয়সী বাসিন্দা সমিতি বাজারের ব্যবসায়ী মানিক মাঝি বলেন, ২০০৩ সালের আগে এই দ্বীপে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। তখন এখানে পড়ালেখার গণ্ডি ছিল প্রাথমিক। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হলেই অনেকেরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেতো।

এই চরের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থাও নাজুক। ১০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জনপদে প্রাথমিক বিদ্যালয় সাকুল্যে ৪টি। ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের দ্বীপে স্কুলের এই সংখ্যা খুব কম বলে মনে করেন উত্তর সন্দ্বীপ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান।

চর ঘুরে দেখা যায়, স্কুলগুলোকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশ সন্তোষজনক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হলো উড়িরচর মেঘনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উড়িরচর এ এইচ নবদিগন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উড়িরচর জি ইউ সৈকত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উড়িরচর বাটাজোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও উড়িরচর স্বর্ণালী শিশু একাডেমি নামে একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুল রয়েছে।

দুপুর দেড়টার দিকে মেঘনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ছেলেরা মাঠে ব্যাট-বল নিয়ে খেলছে। মেয়েরা মাঠের এক কোণে এক্কা-দোক্কায় ব্যস্ত। স্কুলে কে এলো গেলো তা দেখার ফুরসত তাদের নেই। শিক্ষার্থীদের মুখ মলিন দেখা গেলেও সবার পরনে ছিল স্কুল ড্রেস। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হালিমা এসেছে সমিতিবাজার এলাকা থেকে, যা এই স্কুল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। দ্বিতীয় শ্রেণির আজগরও প্রতিদিন ২ কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে আসে।



কথা হয় স্কুলটির প্রধান শিক্ষক অরুণ কান্তি রায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, উড়িরচরে প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা ভালো না। করোনার আগের সময় তার স্কুলে ৩৬৫ জন শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে আছে মাত্র ১৩৮ জন। এই শিক্ষক জানান, তার স্কুলের আশ-পাশেই আছে চারটি মাদ্রাসা। করোনার সময় এ মাদ্রাসাগুলোতে পাঠদান চালু ছিল। অপরদিকে স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুলের শিক্ষার্থী কমেছে। প্রয়োজনের তুলনায় এই চরে স্কুলের সংখ্যা কম। আরও চারটি স্কুল হলে সেই অভাব মিটবে। স্কুল কম হওয়ায় শিশুরা মাদ্রাসায় চলে যায়।

স্কুলের পাশেই জনতা বাজারের পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি হেলাল সওদাগর জানান, চরের স্কুলের সংখ্যা কম হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে এসে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে।

মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই জনপদে স্কুলের সংখ্যা কম হলেও মাদ্রাসার সংখ্যা কম নয়। কিছু দূর পর পরই রয়েছে কওমি ও নূরানি মাদ্রাসা। রয়েছে একটি দাখিল (এসএসসি সমমানের) মাদ্রাসাও। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির চাইতে মাদ্রাসাগুলোতে বেশি। করোনার সময় মাদ্রাসাগুলো খোলা থাকায় সেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। বিপরীতে স্কুলগুলোতে কমেছে।

সন্দ্বীপ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার খোরশেদ আলম জানান, উড়িরচরে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৩৬ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। চারটি স্কুলের তিনটিতেই প্রধান শিক্ষক নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব) দিয়ে চলছে। সাধারণত প্রতি ২ কিলোমিটার পর পর ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকে।

উড়িরচরের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সাধারণত প্রতি ২ কিলোমিটার পর পর ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার কথা থাকলেও উড়িরচরে প্রতি তিন/চার কিলোমিটারেও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে এসে শিশুরা পড়ালেখা করে। স্থানীয়রা চাওয়া এখানে আরও একটি ভালোমানের উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রাথমিক বিদ্যালয় আরও বাড়ুক। একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা হোক। দ্বীপে পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে শিক্ষার্থীদের আর দ্বীপের বাইরে কষ্ট করে যেতে হবে না।

আগের দুই পর্ব
তবুও জীবন থেমে নেই!
৯ বছরে ভাঙনের শিকার ৬৫ বার!

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২২
এসএইচডি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।