ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতালে প্রশিক্ষণ পেয়ে খুশি চিকিৎসকরা

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৪
উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতালে প্রশিক্ষণ পেয়ে খুশি চিকিৎসকরা ...

চট্টগ্রাম: এমডি-১০ প্লেনের ভেতরে বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থানরত বিমানে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে আসা চক্ষু সার্জনরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি দিয়ে কৃত্রিম চোখের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়ে খুশি তারা।  

সরেজমিন পরিদর্শনকালে বাংলানিউজকে এ খুশির কথা জানান তারা।

উড়ন্ত হাসপাতালটি বাংলাদেশে ১১তম বার ও চট্টগ্রামে ৫ম বারের মতো আসলো। আগামী ২ ডিসেম্বর এটি বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।  

রংপুর থেকে আসা ডা. শামীম আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, অরবিস উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতালের এ আয়োজন আমাদের জন্য সত্যিই অনেক ভালো সুযোগ। উপকারী প্রশিক্ষণ। আর্টিফিশিয়ালি আইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ আমাদের দেশে নেই আসলে। এখানে কৃত্রিম চোখের ওপর কাজ শিখছি। অল্প সময়ে অনেক কিছু শেখাচ্ছেন। সাত বছর পর এসেছে অরবিস।  

চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডা. মো. নুরউদ্দিন জাহেদ বলেন, আর্টিফিশিয়াল আইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ায় রোগীর ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এখানে আমাদের স্কিল বাড়ছে। কোনো দ্বিধা থাকবে না। কারণ প্রতিটি ধাপ আর্টিফিশিয়াল আইয়ের ওপর করে এসেছি। উনাদের ধন্যবাদ জানানো দরকার।  

চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডা. নুহীন ইসলাম বলেন, একজন রোগীর চোখে হাত দেওয়ার আগে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা নকল চোখ বা প্রতীকী চোখের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। এখানে সফটওয়্যার এমনভাবে করা হয়েছে মানুষের চোখে হাত দিলে যা অনুভব করবেন তা পাচ্ছি। আপনি বুঝবেন কতটা প্রেসার দিতে হবে, কোনো অংশের ক্ষতি করছেন কিনা, ছুরি অন্য কোনো অংশে লাগছে কিনা। এটা আমাদের জন্য খুব ভালো প্র্যাকটিস। সার্জারিতে সব কিছু হাতের দক্ষতা। দক্ষতা না থাকলে রোগীর সেবা করতে পারবেন না। আমরা যেন সামনে গিয়ে রোগীদের ভালোভাবে সেবা দিতে পারি।  
অরবিস আমাদের শেখাচ্ছে একটি মেশিন দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। আমরা মনে করি, এ প্রশিক্ষণ বাংলাদেশের চক্ষু সার্জনদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  

ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে আসা ডা. শেহেলি জেসমিন বলেন, অরবিস ফ্লাইং আই হসপিটালের ৫ দিনের প্রশিক্ষণে আমরা অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি। যেগুলো আমাদের কর্মস্থলে কাজে লাগবে। তারা অনেক হেলপফুল। এখানে গ্লুকোমা সার্জারি, ফেকো সার্জারি, লেজার চিকিৎসাসহ অনেক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে কৃত্রিম চোখের ওপর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এরপর মানুষের চোখে অস্ত্রোপচার করবো। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আধুনিক সার্জারির ধাপগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি। আমরা চাই অরবিস বার বার বাংলাদেশে আসুক।   

ডা. আনজুমান আরা বেগম জানান, আমরা প্রতিদিন শিখি। তাদের প্রশিক্ষণে ভিন্নতা আছে। যা আমাদের জন্য উপকারী। আমরা চাই তারা নিরমিত আসুক। তরুণ সার্জনদের জন্য অবশ্যই দরকারি।  

অরবিস ইন্টারন্যাশনালের ভাইস প্রেসিডেন্ট (গ্লোবাল কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মার্কেটিং) ক্রিস্টিন টেইলর বলেছেন, অরবিস গত ৩৯ বছর ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছে। এই চার দশকে, অরবিস শিশুদের চক্ষু চিকিৎসা, মাইক্রোসার্জারি, রেটিনা সার্জারি, কর্নিয়াল রোগ এবং আই ব্যাংকিং, প্রিম্যাচিউর শিশুদের রেটিনোপ্যাথি (আরওপি) এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ওপর স্থানীয় চিকিৎসকদের দক্ষতা ও জ্ঞান উন্নত করতে সহায়তা করেছে।

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অরবিস ৭৮ লাখেরও বেশি চক্ষু পরীক্ষা পরিচালনা করেছে, ৪৫ লাখেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের জন্য চিকিৎসা ও অপটিক্যাল সেবা প্রদান করেছে, ২ লাখ ৫৮ হাজারেরও বেশি চক্ষু সার্জারিতে সহায়তা করেছে এবং ৪০ হাজারের বেশি মানুষকে চক্ষু চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে।  

তিনি বলেন,  অরবিস ৪২টি ভিশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে চক্ষু সেবা ছড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নারী-নেতৃত্বাধীন গ্রিন ভিশন সেন্টার যা নারীদের জন্য প্রচলিত বাধাগুলো দূর করে সেবার সুযোগ বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, অরবিস ১৭টি মাধ্যমিক (সেকেন্ডারি) হাসপাতাল, ৪টি তৃতীয় পর্যায়ের (টার্শিয়ারি) হাসপাতাল, ৪ টি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার, এবং ২ টি ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা বা উন্নত করতে সহায়তা করেছে।  

অরবিস ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী পরিচালক (গ্লোবাল কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মার্কেটিং) জেনা মন্টগোমারি বলেন, অরবিস বাংলাদেশের ৪০০টি কমিউনিটি ক্লিনিককে দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রিম্যাচিউর শিশুদের রেটিনোপ্যাথি নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করতে অংশীদার হয়েছে অরবিস। এই রোগটি শিশুদের অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। ২০০০ সালে, অরবিস বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রোগ্রাম চালু করে এবং স্থানীয় চক্ষু হাসপাতাল ও এনজিওদের সাথে চক্ষু রোগ প্রতিরোধ ও দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করে, যা দূরবর্তী এলাকায় যেমন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং সিলেটের নারী চা শ্রমিকদের মধ্যেও পৌঁছে গেছে।

তিনি বলেন, ফেডেক্স অরবিসের মিশনে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সহায়তা দিয়েছে এবং ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অনুদান ও পণ্যসামগ্রী পরিবহনের মাধ্যমে অবদান রেখেছে। ২০২১ সালে, ফেডেক্স তাদের দৃষ্টি সুরক্ষা মিশনে অরবিসের প্রতি নতুনভাবে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে, যেখানে তারা ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেয়। এই অনুদান অরবিসের ফ্লাইং আই হসপিটাল এবং এর প্রকল্পগুলির জন্য আর্থিক, লজিস্টিক এবং অপারেশনাল সহায়তা প্রদান করবে আগামী পাঁচ বছরে। এছাড়াও, ফেডেক্স বিমানযন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পাইলট প্রশিক্ষণ সরবরাহ করে।

ফ্লাইং আই হসপিটালটি পরিচালনা করে ফেডেক্স পাইলটরা, যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সময় দিচ্ছেন এবং সারা বিশ্বে অরবিস প্রকল্পে বিমানটি পরিচালনা করে নিয়ে যান। ফ্লাইং আই হসপিটাল উদ্ভাবন এবং সহানুভূতির এক অসাধারণ উদাহরণ। এটি এমন একটি সম্পদ যা বিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী কোণগুলিতে আশার আলো ও চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিচ্ছে, বলেছেন ফেডেক্স এর ফ্লাইট অপারেশনস এবং এয়ারলাইন প্ল্যানিং এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ব্রাউনলি।  

অরবিস একটি আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা, যা দৃষ্টিশক্তি সুরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অরবিস বিশ্বজুড়ে ২০০ টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে কাজ করছে যাতে ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ উন্নতি করতে পারে। বর্তমানে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ বিলিয়ন মানুষ এমন অন্ধত্ব ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের শিকার যা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অরবিস এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শক্তিশালী ও টেকসই চক্ষু সেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।  

প্রথমবার ১৯৮৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে এই প্রশিক্ষণ প্রকল্প অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থিত ফ্লাইং আই হসপিটাল এবং অরবিসের পার্টনার হাসপাতাল চট্টগ্রাম আই ইনফার্মারি এবং ট্রেনিং কমপ্লেক্সে (সিইআইটিসি) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষণের মূল বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাটারাক্ট, অকুলোপ্লাস্টিকস, সার্জিক্যাল রেটিনা, শিশু গ্লুকোমা এবং কর্নিয়ার মতো চক্ষু রোগের চিকিৎসা। এছাড়াও রয়েছে অ্যানেস্থেশিওলজি, নার্সিং এবং বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রশিক্ষণ। ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ প্রশিক্ষণ চলবে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০  ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৪ 
এআর/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।