চট্টগ্রাম: ৮ বছরের ছেলে মাস্টার ইকরাম খেলতে গিয়ে গিলে ফেলেছিল ছোট একটি এলইডি লাইট, যেটি আটকে যায় তার শ্বাসনালীতে। শ্বাস-প্রশ্বাসে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি হয়ে তার জীবন যখন সংকটাপন্ন, তখন চট্টগ্রামের বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে মিলে চিকিৎসার আশ্বাস।
ফৌজদারহাট থেকে পরিবারের সদস্যরা ইকরামকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. শিমুল কুমার ভৌমিক ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ডা. জিয়াউল কাদেরের নেতৃত্বে অ্যান্ডোস্কোপি টিম লাইটটি তার শ্বাসনালী থেকে অপসারণ করেন। ইকরাম এখন সুস্থ আছে।
২২ বছরের রাখাইন যুবক মং গ্রী থু এর ঘাড়ের পেছনে গুলি লেগে ক্যারোটিড আর্টারির একপাশ উড়িয়ে নিয়ে যায়। ভাস্কুলার সার্জন ডা. মিনহাজুল হাসান এই হাসপাতালে সেই রোগীর অস্ত্রোপচার করে রিং লাগিয়ে দেন (কভার্ড স্টেন্ট)।
২০১৮ সালে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন কাতালগঞ্জ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত পার্কভিউ হাসপাতালে প্রতিদিন তিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। শয্যাসংখ্যা ১৫০টি। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এটিএম রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, রোগ নির্ণয়ের জন্য দরকার বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি। যা এখানে আছে। হার্টের রক্তনালীতে রিং পরানো, পেসমেকারসহ বিভিন্ন ডিভাইস, গলা ও পায়ের রক্তনালীতে রিং, অপারেশন ছাড়াই হার্টের ছিদ্র বন্ধ করা, হার্টের ভাল্ব বসানোসহ সকল ইন্টারভেনশন সেবা, গ্যাস্ট্রোঅ্যান্টেরোলজি, কিডনি ও অর্থোপেডিক রোগীর চিকিৎসা মিলছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব বিভাগকে এক ছাতার নিচে এনে আমরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য, চট্টগ্রাম মহানগরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ৭৪টি। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, রোগীর চাপ বেশি থাকায় ব্যয় বেশি হলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পেতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে।
২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে সেবাদান চালু ও কার্যক্রম শুরু করলেও করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে দেড় বছর পর এভারকেয়ার হাসপাতাল- চট্টগ্রাম এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। এই হাসপাতাল ৪৭০ শয্যাবিশিষ্ট, রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জরুরি বিভাগ, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ), ২৭টি বিশেষ ও উপ-বিশেষ বিভাগ। হাসপাতালটিতে ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি অ্যান্ড কার্ডিয়াক সার্জারি সার্ভিসসহ কম্প্রিহেনসিভ হার্ট সেন্টার, মা ও শিশু সেন্টার, নিউরোসায়েন্স সেন্টার, বোন অ্যান্ড জয়েন্টস সেন্টার এবং ডাইজেস্টিভ ডিজর্ডার সেন্টারসহ ১২টিরও বেশি উন্নত মানসম্পন্ন সেন্টার রয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালটি অ্যাওয়েক ক্র্যানিওটোমি সার্জারি (মাথার হাড় প্রতিস্থাপন), বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশন, বাইল্যাটেরাল নি রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি, বোটক্স ব্যবহার করে সার্ভিক্যাল ডিসটোনিয়া, স্ট্রোক থ্রোম্বলোসিস প্রসিডিওর, ব্রেইন টিউমার রিমুভ্যাল সার্জারি, থোরাসিক অ্যান্ডোভাসক্যুলার অ্যারোটিক রিপেয়ার (টিইভিএআর) প্রসিডিওর, ভার্টিব্রা জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে এমআইএস (মিনিম্যালি ইনভ্যাসিভ সার্জারি) এবং পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি প্রসিডিওরসহ বেশকিছু মাইলফলক অর্জন করেছে।
হাসপাতালের সিওও সামির সিং বলেন, এভারকেয়ার হসপিটাল চট্টগ্রাম সফলভাবে ৫ শতাধিক স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা সম্পন্ন করেছে, যাদের মধ্যে ১৫ জনের জীবন থ্রম্বোলাইসিস পদ্ধতির মাধ্যমে রক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া গত দুই বছরে ৫০টির বেশি কার্ডিয়াক অপারেশন সফলভাবে করা হয়েছে।
১৯৮০ সালে জিইসি মোড়ে গড়ে ওঠা মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে বর্তমানে শয্যাসংখ্যা ১৫০টি। প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৩০ জন রোগী ভর্তি থাকে। কনসালট্যান্টসহ চিকিৎসক ও নার্স আছেন দুই শতাধিক। ২০১৮ সালে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ গাইনি, শিশু ও এনআইসিইউ ওয়ার্ড যুক্ত হয় এই হাসপাতালে। করোনাকালে চিকিৎসাসেবা দিয়ে প্রশংসিত হন চিকিৎসকরা। বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হচ্ছে সফলতার সাথে। গলায় আটকে থাকা মাছের কাটা ভিডিও অ্যান্ডোসকোপির মাধ্যমে খুঁজে বের করে নিয়ে আসা, কানের কিলয়েড অপারেশন, শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি কানের ভিতরে পানি জমে থাকার ফলে (গ্লু-ইয়ার) কান পাকা, অ্যাটিলেক্টাসিস, অ্যাডিনয়েড, টনসিল সমস্যার চিকিৎসা সফলভাবে সম্পন্ন করে এখানকার সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) ডা. আলমগীর মো. সোয়েব বেশ প্রশংসিত। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মনিরুজ্জামানের দাবি, গত কয়েক দশকের ব্যবধানে চট্টগ্রামে মেডিকেল সেন্টার হসপিটাল নানা শ্রেণির রোগীর আস্থার ঠিকানায় পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে দক্ষ ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট টিম ওপেন হার্ট সার্জারি করছে দক্ষতার সাথেই। ১৩৫ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১০০ রোগী ভর্তি থাকে। চিকিৎসক আছেন শতাধিক। হার্টের রোগীদের চিকিৎসা দিতে পাঁচজন কার্ডিওলজিস্ট সার্বক্ষণিক হাসপাতালেই থাকেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ কে এম ফজলুল হক জানান, আমাদের চিকিৎসাসেবায় যুক্ত করেছি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এখানে স্বয়ংসম্পূর্ণ কার্ডিওভাসকুলার বিভাগ আছে। চট্টগ্রামের প্রথম হার্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে।
সিএসসিআর কার্ডিয়াক বিভাগের ক্যাথল্যাব পরিচালক ডা. ইব্রাহীম চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামে হৃদরোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ঢাকার বাইরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার হৃদরোগীদের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল চট্টগ্রাম। সিএসসিআরে কার্ডিয়াক ক্যাথল্যাব স্থাপনের পর থেকে ৫৫০ জনের অধিক রোগীর হার্টে রিং পরানো হয়েছে। এনজিওগ্রাম করা হয়েছে দেড় হাজার জনের। এছাড়া পেসমেকার লাগানো হয়েছে ১৫০ জনের।
চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের বিদেশ যাত্রা কমাতে চট্টগ্রামে ৩৭৫ শয্যার বিশেষায়িত ইম্পেরিয়াল হসপিটাল উদ্বোধন হয় ২০১৯ সালের জুনে। আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে নগরের পাহাড়তলীতে ৩৭৫ শয্যার এই হাসপাতালটি ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এটি। পাঁচটি ভবন নিয়ে গড়া এই হাসপাতালে রয়েছে সার্বক্ষণিক জরুরি সেবা, কার্ডিয়াক, ট্রান্সপ্ল্যান্ট, নিউরো, অর্থোপেডিক্স, গাইনিসহ ১৪টি অপারেশন থিয়েটার। নবজাতকদের জন্য রয়েছে ৪৪ শয্যার নিওনেটাল ইউনিট, ৮টি পেডিয়াট্রিক আইসিইউ। মুমূর্ষু রোগীদের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য ৬৪ শয্যার ক্রিটিক্যাল কেয়ার রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এ ছাড়া অসচ্ছল রোগীদের জন্য ১০ শতাংশ শয্যা সংরক্ষিত রাখা আছে হাসপাতালে। লাইফ সাপোর্টভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্স এবং মুমূর্ষু রোগীকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে স্থানান্তরের জন্য আছে হেলিপ্যাডের ব্যবস্থা।
লাখো মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সবার কাছে এটি পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল নামে পরিচিত। হাসপাতালের জনসংযোগ বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ৭০০ রোগী বিভিন্ন বিভাগে চোখের সেবা নিয়ে থাকেন। বছরে ২ লাখের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। রোগীদের সেবা দিতে বিশেষজ্ঞসহ ৫০ জনের চিকিৎসক দল রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ রোগীর অস্ত্রোপচার হয়। এখানে রয়েছে ৯টি আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষে রেটিনা প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে সব ধরনের জটিল অপারেশনের ব্যবস্থা। বছরে প্রায় ৩০ হাজার রোগী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। হাসপাতালটিতে ১৩টি ব্লকে রয়েছে ১০০টি সাধারণ শয্যা ও ৩৫টি বিভিন্ন ধরনের কেবিন। এ ছাড়া শিশুদের চোখের ক্যানসার চিকিৎসায় আছে আলাদা বিভাগ। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় আউটডোরে চক্ষুসেবার কর্মযজ্ঞ, চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। শনিবার বন্ধ থাকলেও সপ্তাহের সাতদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে জরুরি বিভাগ। তবে শুক্রবার আউটডোরে সেবা মেলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা প্রতিদিন চোখের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হাজির হন এই হাসপাতালে।
আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতাল, মেহেদীবাগ এলাকার ন্যাশনাল হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, প্রবর্তক এলাকার শেভরণ, বায়েজিদ আরেফিন নগরে সাজিনাজ হাসপাতালে জটিল রোগীর চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসকরা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সোমা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে শয্যার তুলনায় রোগীর চাপ বেশি। সীমিত জনবল দিয়ে এত রোগীর চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়। বেশি রোগীর কারণে সরকারি হাসপাতাল সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্ন রাখা কঠিন। এ অবস্থায় সেবাপ্রার্থীরা ঝুঁকছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে। স্বাস্থ্যসেবা পেতে ব্যয় বেশি হলেও অব্যবস্থাপনা এড়াতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে রোগীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২৪
এসি/টিসি