ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

সংখ্যাগুরুর ভাষা কি প্রভাবিত করে সংখ্যালঘুর ভাষাকে!

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
সংখ্যাগুরুর ভাষা কি প্রভাবিত করে সংখ্যালঘুর ভাষাকে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: রাজনৈতিক ভাষাই কি তবে যুগে যুগে দেশের জনগণের ভাষায় পরিণত হয়েছে? শক্তিশালীর ভাষা কি ধীরে ধীরে দখল করে নিয়েছে সংখ্যায়লঘুর ভাষাকে! নাকি সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষাকে আত্মস্থ করেছে রাজনীতি আর সমাজ! সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা পরিণত হয়েছে রাজনীতি বা প্রশাসনের ভাষায়।

আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের প্রাক্কালে এই প্রশ্ন আলোচনায় এলে খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না।



সাধারণ মানুষের ভাষা যে রাজনীতি এবং প্রশাসনের সর্বোপরি জাতীয় ভাষা হয়ে ওঠে তার সবথেকে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। আমারা  জানি বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে লড়াই বাংলাদেশের মানুষ করেছিলেন সেই লড়াই বিশ্বের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

প্রতিটি রাষ্ট্রে এক বা একাধিক রাষ্ট্র ভাষার থাকে। ঠিক যেমন থাকে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠী। আকারে বড় দেশগুলির দিকে নজর করলে দেখা যাবে সেখানে একাধিক রাষ্ট্র ভাষা থাকলেও তার বাইরেও বেশ কিছু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। যেগুলি কিছু অনেক সময়েই রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়।

আমারা যদি চীনের কথা আলোচনা করি, সেখানে আমরা দেখতে পাবো ‘স্টান্ডার্ড ম্যান্ডারিনকে ‘অফিসিয়াল’ ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও অন্তত ১৩টি উপ ভাষায় চীনে কথা বলা হয়। এছাড়াও আরও কিছু ভাষা চীনের বিভিন্ন অংশে ব্যবহার করা হয়।

ভারতের সংবিধানে মোট ২২টি ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হিন্দি এর সঙ্গে আছে বাংলা, অসমীয়া, গুজরাটি,কানারা,কাশ্মীরি, বোডো, উর্দু, তামিল সহ আরও বেশ কিছু ভাষা। কিন্তু ভারতের ভাষা বললেই, প্রথমেই ‘হিন্দি’ সামনে উঠে আসে।

ভারতে ২০০১ সালের জনগণনা হিসেবে প্রায় ৪২ শতাংশ ভারতীয় হিন্দিতে কথা বলেন, ৮ শতাংশের কিছু বেশি বাংলায়, ৭ শতাংশের কিছু বেশি তেলেগুতে এবং প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ মারাঠি ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু কেন তবে ভারতের ভাষা বললেই হিন্দি ভাষার কথা ধরে নেওয়া হয়?

এটুকু পড়ে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন, সংখ্যাগুরু মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাই দেশে এবং গোটা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। এখানে তথ্যটি কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো।

‘ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া’র  ২০০৭ সালের হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর ১৪ শতাংশের বেশি মানুষ ‘স্টান্ডার্ড ম্যান্ডারিন’ ভাষায় কথা বলেন যেখানে ইংরেজিতে কথা বলেন মাত্র ৫.৫২ শতাংশ।

তবে কেন ‘স্টান্ডার্ড ম্যানডারিন’-এর থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং চালু ভাষা ইংরেজি। এই প্রসঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘পুরাণ ধাঁধা’ কবিতার একটি পঙক্তি মনে আসে, ‘হিং-টিং-ছট' প্রশ্ন এসব, মাথায় মধ্যে কামড়ায়’-এর মাধ্যমে যথার্থভাবে পরিস্থিতির বর্ণনা করা যেতে পারে।

তার পরের লাইনে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ‘বড় লোকের ঢাক তৈরি, গরীব লোকের চামড়ায়’। এই কথাটিকেও ফেলে দেওয়া যায় না। ভারতে  যারা বাংলায় বা অন্য আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন তারা নিত্য নৈমিত্তিক ভাবে ইংরেজি এবং হিন্দির চাপে পিষ্ট হন।

এই ধরনের প্রভাব প্রায় প্রতিটি দেশেই দেখা গেছে। তবে কি এর কারণ আর্থ সামাজিক। আর্থিকভাবে শক্তিশালী বলেই কি ইংরেজি আন্তর্জাতিক  ক্ষেত্রে কথা বলার এবং লেখার ভাষা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

প্রশ্ন কিন্তু এখানেই থেমে থাকছে না। হতে পারে অপ্রিয় কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি আমাদের থেকে দুর্বলতরো জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলিকে নিয়ে কতটা চিন্তিত। পশ্চিমবঙ্গের খাস, কোল, বিল মুন্ডা কিংবা বাংলাদেশের সিলেটি, চাকমা, গাড়ো, রংপুরি, চিটাগাঙের ভাষা। অবশ্যই ভাবার দরকার আছে।

২০০৫ সালের প্রকাশিত ‘এথোনোলগ; ল্যাঙ্গুয়েজস অফ দ্যা  ওয়ার্ল্ড’-এর ১৫ নম্বর সংস্করণে বলা হয়েছিল বিশ্বে প্রচলিত ৬৯১২টি ভাষার মধ্যে ৫১৬টি খুব তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।  

ইংরেজ আসার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে সংস্কৃত ভাষা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজদণ্ড ব্রিটিশের হাতে উঠতেই অল্প লোকের ভাষা ‘ইংরেজি’ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করল। পিছিয়ে পড়ল দ্রাবিড়, মাগধি কিংবা এক সময়ের প্রশাসনিক ভাষা তুর্কি এবং ফার্সি।

কিন্তু মাতৃভাষাসহ ভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় উপায় কি? আদৌ কি কোন উপায় আছে এই সমস্যার সমাধানের। চিন্তার প্রয়োজন! তবে একটা কথা বলাই যায় মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে সচেতনতা অবশ্যই একটা মাধ্যমে হতে পারে। সেটা সমস্ত ভাষায় কথা বলা মানুষের ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
ভিএস/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।