ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

কলকাতার যে রাস্তাগুলো রাঁধুনিদের নামে

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৬
কলকাতার যে রাস্তাগুলো রাঁধুনিদের নামে

কলকাতা: কলকাতা শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য ও এর ছোটো ছোটো ইতিহাস। যে ইতিহাস হয়তো কলকাতার পাতায় অনেকটাই আবছা হয়ে গেছে।

বইয়ের পাতায় না থাকলেও, প্রতিদিনই কানে আসে গলি থেকে রাজপথ নিয়ে বিভিন্ন তথ্যের চর্চা। এই চর্চা থেকে জানা যায় শহরের বিভিন্ন পাড়ার ইতিহাস। সেটি অবশ্যই কলকাতার পুরনো বাসিন্দাদের কাছে।

কলকাতায় প্রতিদিনই অলি-গলিতে ঘোরা হয়। কিন্তু এবার সেই বহুমাত্রিক চর্চার একটি তথ্যকে সামনে রেখে ঘোরা। ঘুরতে ঘুরতে সামনে উঠে এলো কতোগুলো অবাক করা তথ্য। যা অন্য যেকোনো শহরের থেকে কলকাতাকে একদম আলাদা করে দেয়।

কলকাতা চিরকালই নানা জাতি, নানা সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যময়। এমনকি খাবার-দাবারেও। কোনো খাবার এসেছে পর্তুগিজদের রান্নাঘর থেকে। আবার কোনোটা মুঘলদের পাকঘর থেকে। আবার কোনো ব্রিটিশ পদ মিশে গেছে বাঙালি রান্নাঘরে।

রান্না যখন মিশেছে তখন আবশ্যিকভাবেই মিশেছেন রাঁধুনিরা। সাধারণত খাওয়ার পদটি মনে থাকলেও, সঙ্গত কারণেই পদটির সৃষ্টিকারী অর্থাৎ রাঁধুনির নাম মনে থাকে না আমাদের। কিন্তু তাদের সৃষ্টি রসনা আমাদের তৃপ্ত করে এসেছে বংশ পরম্পরায়।

বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা রাঁধুনিরাও যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন, কলকাতায় উড়িষ্যা রাজ্য থেকে আসা রাঁধুনিদের একটা বিশেষ চাহিদা রয়েছে আজও। ষাটের দশক থেকে শুরু করে বাঙালি বাড়িতে রাঁধুনি মানেই ধরে নেওয়া হতো তিনি ওড়িশার মানুষ।

যদিও আজ কলকাতার যেকোনো খাওয়ার অনুষ্ঠান দখল করে নিয়েছে ক্যাটারাররা। তবে বছর কুড়ি আগে পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার বাঙালি বাড়ির অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হলেই বাড়ির কর্তা হাজির হতেন ভবানীপুরের ওড়িয়া পাড়ায় বা মুদিয়ালি অঞ্চলে। আবার উত্তরের ভোজনরসিক বাঙালি রান্নার ঠাকুরের খোঁজ করতেন বাগ বাজারের বিশেষ কয়েকটি গলিতে।

যেকোনো শহরের রাস্তা বা গলির নাম হয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে। কিন্তু কলকাতার খাদ্যরসিকরা রাঁধুনি বা খানসামাদের শুধু মনেই রাখেননি, তাদের নামে বিভিন্ন রাস্তার নামও দিয়েছেন।

যেমন- ছকু খানসামা লেন, চমরু খানসামা লেন, পাঁচু খানসামা লেন, করিম বক্স খানসামা লেন, নিমু খানসামা লেন, মিসরী খানসামা লেন, পিরু খানসামা লেন, গদাই খানসামা লেন রাস্তাগুলো উল্লেখযোগ্য।

জেনে রাখা ভালো, সেকালে অর্থাৎ ষাটের দশকে যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাড়িতে গিয়ে রান্না করতেন, তাদেরকে ঠাকুর বা খানসামা বলা হতো।

প্রতিটি রাস্তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এর নামের ইতিহাস। আমাহস্ট্রিট এলাকায় একটি গলির নাম ছকু খানসামা লেন। শোনা যায়, কলকাতার সেসময়োর বিখ্যাত এ রাঁধুনি এই গলিতেই তার ডেরা বেঁধেছিলেন।

ঠিক তেমনি পার্কসার্কাস এবং বালিগঞ্জের সংযোগ স্থলে চামারু খানসামা লেন। চামারু রাঁধুনি এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। বড়বড় অনুষ্ঠানের মোগলাই খাবার রান্না করার জন্য ডাক পড়তো চামারু খানসামার। তার নামে ওই রাস্তার নাম হয়েছে চামারু খানসামা লেন।

ছকু খানসামা লেনে ঘুরতে ঘুরতে সামনে এলো আরও একটি ইতিহাস। এই গলির ১৯/৩ নম্বর বাড়ির সামনে বসানো একটি শ্বেত পাথরের ফলক। যেখানে লেখা ওই বাড়িতে ১৯০৭ সালে কিছুদিন বাস করেছিলেন ঋষি অরবিন্দ।

বিহারি রাঁধুনিদেরও কদর কম ছিলো না কলকাতায়। সেরকম একজন রাঁধুনি ছিলেন মিসরী খানসামা। তার নামে একটি রাস্তা ছিলো। রাস্তা ছিলো গদাই খানসামার নামেও। তবে এই রাস্তাগুলোর বেশ কয়েকটির নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেমন আমাহাস্ট্রিটের কাছে পাঁচু খানসামা লেন হয়ে গেছে ড. ডি মুখাজ্জি রো।

দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালি, যার আগের নাম ছিলো খানসামা পাড়া। আজ মুদিয়ালি নামে পরিচিত। এখানেও ভিন্নরাজ্য থেকে আসা রাঁধুনিদের একাধিক ডেরা ছিলো বলে জানা যায়। নতুন সময় দখল করে নেয় পুরনো ইতিহাসের অধ্যায়গুলোকে। বিভিন্ন কারণে বদলে যায় পাড়ার নাম, রাস্তা, এমনকি বাড়ির নামও।

সেভাবেই অনেক রাস্তার নাম বদল হয়েছে। স্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে খানসামাদের নানা জানা-অজানা গল্প। কথায় বলে, একটি শহরের ইতিহাস ছড়িয়ে থাকে পথের বিভিন্ন বাঁকে। ঠিক তেমনই কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে রয়েছে এই রাস্তাগুলো। যা কলকাতার বিখ্যাত রাঁধুনি বা খানসামাদের মনে রেখেছে এতো বছর পরেও।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৬
ভিএস/এসএনএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।