ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

আদালতের নির্দেশে ২০ বছর পর বিদ্যালয়ের চাকরি ফিরে পেলেন আকবর!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২৩
আদালতের নির্দেশে ২০ বছর পর বিদ্যালয়ের চাকরি ফিরে পেলেন আকবর!

পঞ্চগড়: ১৯৯২ সালের কথা। প্রত্যন্ত গ্রাম নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রামের শিশু শিক্ষায় ছিল না কোনো বিদ্যালয়।

এ সময় নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ হাতে গড়ে তোলেন আকবর হোসেন নামে এক ব্যক্তি। এর মধ্যে নিজের গড়া বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন তিনি।  

বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর রেজিস্টেশন হয় এবং আকবরসহ শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হন। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছিল। এর মধ্যে পারিবারিক কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন আকবর। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকার দীর্ঘ ২০ বছর পর অবশেষে আদালতের নির্দেশে নিজের পদ ফিরে পেয়েছেন আকবর হোসেন।

বৃহস্পতিবার (০২ নভেম্বর) সব কার্যক্রম শেষে দুপুরে নিজ হাতে গড়ে তোলা নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তিনি। এ সময় বিদ্যালয়ে সাবেক সহকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

আকবর আলীর বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের কাপরাঙ্গাপাড়ায়।

পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। তার অনেক আগেই ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি হবিবর রহমানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ষড়যন্ত্রের শিকার হন প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আকবর। ২০০১ সালে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের একটি মামলায় তিন মাস কারাগারে থাকতে হয় তাকে। পরে সমঝোতা হওয়ায় জামিনে মুক্তি পান তিনি। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিদ্যালয়ের সভাপতি হবিবর রহমান প্রধান শিক্ষক আকবর হোসেনকে আর বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি। এভাবে চলে যায় কয়েক বছর। এর মধ্যে ২০০৪ সালে আদালতে আদেশাত্মক নিষেধাজ্ঞার মামলা করেন আকবর। মামলায় আদালত আকবরকে স্বপদে বহাল ও তার বকেয়া বেতন পরিশোধের নির্দেশ দেন। তারপর থেকেই মামলার পাল্টা আপিলে চলে গেছে তার জীবনের ২০টি বছর।

আকবর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এ মামলার পেছনে আমার সবকিছু শেষ করে ফেলেছি। ২০ বছর ধরে আমি সংগ্রাম করেছি। চরম অভাবে দিন পার করেছি। তবুও ন্যায়বিচারের আশায় বছরের পর বছর ঘুরেছি। সভাপতি হবিবর রহমান, এটিইও আকবর আলী, জিন্নাত আলী ও টিইও রুস্তম আলী মিলে আমাকে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আজ ২০ বছর পর আদালতের নির্দেশে আমাকে আমার পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আমাকে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলোতে আর যেন হয়রানি না করা হয়, সেই দাবি জানাই।

আকবর হোসেনের পরিবার জানায়, ১৯৯২ সালে নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন আকবর হোসেন। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। তার অনেক আগেই সভাপতি হবিবর রহমানের ষড়যন্ত্রের শিকার হন আকবর হোসেন। আকবরকে সরিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্টরা সভাপতির ভাতিজার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকাকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেন। এরপর এ মামলা গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। চলেছে রায় আর পাল্টা আপিল। সবশেষ ২০২২ সালের ১৮ মে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং আয়েশা সিদ্দিকার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া আয়েশা সিদ্দিকাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর আকবরকে যোগদান করাতে টালবাহানা শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তারা তাকে ঘোরাতে শুরু করে। উপায় না পেয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে পঞ্চগড় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একটি জারি মামলা করেন আকবর।

এরপর আকবর হোসেনের যোগদানে আদালতের নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে আদালত গত ২৯ অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর তড়িঘড়ি করে বৃহস্পতিবার পঞ্চগড় সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আকবর হোসেনকে যোগদান করিয়ে বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক আজম আলী প্রধান বলেন, আমরা একসঙ্গে শিক্ষকতা শুরু করি। এ বিদ্যালয়ের জন্য তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। তারপর দীর্ঘ ২০ বছর আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরেছেন। আজ তিনি আবার যোগদান করায় আমরা খুবই আনন্দিত। আকবর আলীর স্ত্রী জোসনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী নিজেই এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ওই সময় এখানে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। কিন্তু আমার স্বামীকে ষড়যন্ত্র করে বহিষ্কার করা হয়। মামলা চালাতে গিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আজ আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই।  

মামলার বিষয়ে কথা হয় আকবর হোসেনের আইনজীবী আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি আকবর হোসেনের জারি মামলার আইনজীবী ছিলাম। সংশ্লিষ্টরা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানায় এ মামলা করা হয়। বিবাদীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও তারা কোনো জবাব না দেওয়ায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি করেন। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই করে তাকে বিদ্যালয়ে যোগদান করিয়েছেন।

এদিকে যোগদানের আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয় পঞ্চগড় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি জানান, দীর্ঘ চাকরি সংক্রান্ত মামলা চলার পর আদালতের নির্দেশে আকবর হোসেনকে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০২৩
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।