ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আগামীর প্রজন্ম ব্যর্থ হবে না: ইনাম আল হক

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১২
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আগামীর প্রজন্ম ব্যর্থ হবে না: ইনাম আল হক

ঢাকা: ইনাম আল হক-পাখি বিশেষজ্ঞ, আলোকচিত্রী, লেখক, পর্যটক; সব ছাপিয়ে একজন নিসর্গপ্রেমী মানুষlএ মানুষটির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতিপ্রেমকে ঘিরেই আবর্তিত।

সংকটাপন্ন বাংলাদেশের প্রকৃতি-জীববৈচিত্র্যের নানা প্রসঙ্গে কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে সোমবার বিকেলে কথা বলি তার সঙ্গে।



বনানী ডিওএইচএস’র বাসায় দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি যা জানালেন, তার মধ্যে ছিল না আবেগের ছড়াছড়ি। নানা বিষয়ে বাস্তবতাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি।  

বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের বহুমাত্রিক সংকটের জন্য প্রধানত জনসংখ্যার অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসনকেই দায়ী করেন তিনি।

বর্তমানে জীব-বৈচিত্র্যের হুমকি হিসেবে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার সিংহভাগ জনসংখ্যাবৃদ্ধিজনিত কারণেই সৃষ্ট-অভিমত ইনাম আল হকের।

তিনি মনে করেন, সংকট এমন পর্যায়ে রয়েছে যে এর কার্যকর কোন সমাধান অত্যন্ত কঠিন। জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। স্বাধীনতার পূর্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ ছিল, বর্তমান ও স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলোর প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে খুবই সামান্য।

একটি দেশের সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্র কেবল গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নয়, নি:সন্দেহে অপরিহার্য অংশ বলেও মনে করেন ইনাম আল হক।

তিনি জানালেন, বাংলাদেশে ৬শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে ২শ’ প্রজাতি জলচর, এরা মূলত: উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। এদের মধ্যে গোলাপী হাঁস, বাদি হাঁস এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। বিপণœ হওয়ার পথে বালি হাঁস, নাকতা হাঁস, মেটে হাঁস। সরালিসহ অন্য যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের খুব বেশি সময় দেখা যাবে না বলে মনে হচ্ছে। পাখিসহ অন্য প্রাণীদের  অন্যতম খাবার ঝিনুক-শামুক এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা বস্তায় ভরে ফ্যাক্টরিতে পাঠাচ্ছে।

ইনাম আল হক জানান, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে দুই যুগ আগে। এসময় দেশে গরুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথানাশক প্রয়োগ করা হয়। ডাইক্লোফেনাক ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর মারা যাওয়া গরুর শব খেয়ে শকুন মৃত্যুর যে মিছিল শুরু হলো তা অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও হুমকি তৈরি করে।  

শকুনেরা পূর্বে যেসব মরা প্রাণীদের শব খেয়ে প্রকৃতিকে জীবাণুমুক্ত রাখতো এদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কুকুর, শিয়াল ও অন্য প্রাণীরা তা খেতে শুরু করলো। এর ফলে জলাতঙ্কের প্রকোপ ক্রমেই বাড়তে থাকলো। বর্তমানে নদী-নালা খাল-বিলেও ডাইক্লোফেনাকের উপাদান পাওয়া যাচ্ছে।

বিদেশে প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও আমাদের দেশে তা মানা হয়না। এসব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন আইন আছে বলেও জানা নেই।

তবে জীববৈচিত্র্যের চলমান ও ভবিষ্যত সংকটের জন্য সরকারের চেয়ে সমাজনেতাদেরই এক্ষেত্র্যে বেশি ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তবে শিক্ষিত সমাজ সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মত তাঁর।

সরকারের ভূমিকা সামগ্রিক অর্থে খুবই সামান্য বলে মনে করেন তিনি। কারণ একটি সরকার মাত্র ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন আর সমাজনেতারা আজীবন মানুষের উপর সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তারা যদি অনবরত এসব সংকটের কথা বলে যেতেন, তাহলে সেটি সমাজে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতো।

ইনাম আল হক বলেন, আমাদের প্রজন্ম ও পূর্বের প্রজন্ম জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা ব্যর্থ হলেও আগামীর প্রজন্ম ব্যর্থ হবে না আমার বিশ্বাস।

প্রকৃতিপ্রেমীদের সংযোগ

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত-শান্তির এই দেশে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সামিটে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে অংশ নেন নিসর্গপ্রেমী ইনাম আল হক। সেখানে দেশটির পরিবেশমন্ত্রীর কাছে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন দু’দেশের প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের  জন্য প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের ।

দু’দেশের প্রকৃতিপ্রেমীদের অংশগ্রহণে হবে সে পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন স্থান ঘুরে তোলা প্রকৃতি, পাখি ও অন্যসব প্রাণিদের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী-শুরুটা হবে ভুটান থেকেই। এমন প্রস্তাবে ভুটানের পরিবেশ মন্ত্রী সাড়া দেন। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬ জন ও ভুটানের ৮ জন মিলে প্রকৃতি ভ্রমণের পর তাদের তোলা আলোকচিত্র নিয়ে একটি প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয় ভুটানে।

আলোচনার শেষের দিকে ইনাম আল হক এসব তথ্য তুলে ধরে  জানালেন, আমাদের দেশের চেয়ে ভুটানের  জীববৈচিত্রের অবস্থা লক্ষ গুণ ভাল। সেখানে পাখির সংখ্যা সাড়ে সাতশ’ প্রজাতির। সেখানে দিনের পর দিন হেঁটে প্রত্যক্ষ করি এক সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের চিত্র। ফুবজিগা গিয়ে বিপণ্ণ পাখি কালাগলা-সারস, পুনাখা গিয়ে ফচু ও মচু নদীতীরের অতি-বিপন্ন পাখি ধলাপেট-বক, ‘জিগমে দর্জি জাতীয় উদ্যানে’ বিরল পাখি কালালেজ-গুরগুরি ও, ‘চেলেলা’ শিখরে উঠে রক্তাক্ত-মথুরা দেখার সৌভাগ্য হয়।

তিনি আরো জানান, ভুটানে বিপন্ন দু’টি প্রজাতির পাখি পুনরুদ্ধারে কত রকম প্রচেষ্টা হচ্ছে কিন্তু আমাদের অসংখ্য পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আমরা কিছু করতে পারছি না।

আমাদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালে ভুটানের প্রকৃতিপ্রেমীদের একটি দলও বাংলাদেশে আসবে বলেও জানান ইনাম আল হক।

বাংলাদেশ সময়: ০২22 ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।