ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উত্তাপ ঠেকাতে রোপিত গাছ মরছে অযত্নে

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৪
উত্তাপ ঠেকাতে রোপিত গাছ মরছে অযত্নে ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: কয়েক বছর ধরে গরম মৌসুমে অসহনীয় তাপমাত্রা ভোগাচ্ছে রাজধানীবাসীকে। এক্ষেত্রে নগরে গাছপালার অভাব, জলাশয়ের অপ্রতুলতার কথা বলে আসছিলেন পরিবেশবিদরা।

রাজধানীর তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে তাই দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র। পরিকল্পনা মোতাবেক, সড়ক বিভাজক থেকে শুরু করে ফুটপাতেও গাছ লাগিয়েছিল সংস্থাটি। তবে অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে এসব গাছ। অবশ্য দুই লাখ গাছ লাগানোর কথা থাকলেও রোপণ হয়েছে ৫০ হাজার। বাকি গাছগুলো পর্যায়ক্রমে লাগানো হবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি।  

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লাগানো এসব গাছের প্রতি অবহেলা আর অযত্ন চোখে পড়ে। ২০২৩ সালের ২ মে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় দুই লাখ গাছ রোপণের ঘোষণা দেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ঘোষণার পর থেকে গাছ রোপণ শুরু হয়। মিরপুর সড়ক, মহাখালী, বনানী, গুলশানসহ উত্তর সিটির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়কে এসব গাছ লাগানো হয়।

তবে সরেজমিনে দেখা যায়, যথাযথ পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছ মরে গেছে। আবার অনেক গাছ মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মিরপুর ১, ২, ৬, ৭, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর এলাকার প্রধান সড়কের দুই পাশে ফুটপাত ও মেট্রোরেলের নিচের বিভাজকে গাছ লাগানো হলেও সঠিকভাবে পরিচর্যা দেখা যায়নি। এখানে বেশ কিছু গাছ পরিচর্যার অভাবে মরেছে ও মরার উপক্রম হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কোথাও ভেঙেছে গাছের নিরাপত্তায় লাগানো বাঁশের খাঁচা।  

মহাখালীর আমতলী থেকে গুলশান-১ পর্যন্ত বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কের বিভাজকে উন্নয়নকাজের জন্য শতাধিক বড় আকৃতির গাছ কাটা হয়। পরে সেসব স্থানে রোপণ করা হয়েছে গাছের চারা। গুলশানের কিছু এলাকায় দেখা যায়, বেশ কিছু গাছের গোড়ার মাটি সরে গেছে।

মহাখালী এলাকায় দেখা যায়, অনেক গাছ মরে গেছে। কোথাও আবার গাছ থাকলেও বাঁশের খাঁচা নেই। কোনো কোনো গাছ ভরে গেছে আগাছায়। এমনকি কালশী সড়কের উত্তর পাশের ফুটপাতে গাছশূন্য খাঁচা পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ফুটপাতে লাগানো গাছগুলোর যত্ন নিয়ে উদাসীনতা দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। ফুটপাতসহ দোকানের সামনের অংশে ঝাঁড়ু দিয়ে ময়লা রাখা হচ্ছে গাছের গোড়ায়। ফুটপাত ঘিরে অবৈধ দোকানিরাও ময়লা গাছের গোড়ায় ফেলছে।

মিরপুর পল্লবী এলাকার পথচারী মোহাম্মদ আলী বলেন, দিনকে দিন রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে। এখন আবার পরিবেশের উল্টো-পাল্টা আচরণের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। রাস্তার ফুটপাতের গাছগুলো অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। যেন এই গাছগুলো দেখভাল করার কেউ নেই। কেউ আবার ফুটপাতের গাছগুলোর বাঁশের খাঁচা খুলে নিয়েছে, কেউ ভেঙে ফেলেছে। এমনকি অনেক জায়গায় দেখেছি গাছ মরে গেছে। ফুটপাতের গাছগুলো যেন দায়সারা কাজের সাক্ষী।

গাছের যত্নে মালি নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা পিয়াল হাসান বাংলানিউজকে জানান, এখন পর্যন্ত উত্তর সিটিতে ৫০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। এই গাছগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য বিভিন্ন কমিউনিটি ও সোসাইটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।  

কত গাছ মরেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানতে চাইলে তথ্য কর্মকর্তা জানান, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে গাছগুলোর বাঁশের খাঁচা ভেঙে যায়। সেগুলো পুনরায় স্থাপন করা হয়। এযাবত কত গাছ মরে গেছে এর হিসাব আসলে থাকে না।  

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাছগুলোকে দেখভাল করার জন্য ১০০ মালি নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। গত দুই মাস আগে ১৫ জন মালি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বস্তি এলাকায় কী পরিমাণ গাছ লাগানো হয়েছে জানতে চাইলে পিয়াল বলেন, বস্তি এলাকায় চিফ হিট অফিসার প্রায় সাড়ে আট হাজার গাছ রোপণ করেছেন। কড়াইল বস্তি, মহাখালী সাততলা বস্তি ও ভাষানটেক বস্তিসহ মোট সাতটি বস্তিতে গাছগুলো লাগানো হয়েছে। এই গাছগুলো রোপণ করতে সহযোগিতা করেছে লংকাবাংলা, গ্রিন সেভারস ও কমিউনিটি টাউন ফেডারেশন।  

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ব্যাপক বৃক্ষরোপণ শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে। গত বছর ‘সবুজে বাস বারো মাস’ স্লোগানে দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছি। পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে ঢাকাকে আবার সবুজ শ্যামল নয়নাভিরাম ঢাকায় পরিণত করার কার্যক্রম শুরু করেছি। ক্লিনিং, গ্রিনিং ও ফিডিং এই তিনটিকে বিবেচনায় নিয়ে আগামী দুই বছরে দুই লাখ গাছ লাগানো হবে। এরই মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে।  

গাছগুলোর পরিচর্যা কীভাবে হচ্ছে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, গাছ লাগানো অনেক সহজ কিন্তু গাছ বাঁচানো অনেক কঠিন। লালন-পালন করা অনেক কঠিন। তাই গাছকে লালনের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০০ জন মালি নিয়োগ দেবে। নিয়োগের কাজটি প্রক্রিয়াধীন। আমরা একটি জিআইএস ম্যাপ তৈরি করেছি। যেটির মাধ্যমে জায়গা নির্বাচন, গাছ মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া আমাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ছাদকৃষির ওপরে ১০ শতাংশ করছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

‘সবুজায়নের কাজে পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের যুক্ত করতে হবে’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলানিউজকে বলেন, গাছ যেকোনো নগরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরিবেশের ভারসাম্য ও পরিবেশ শীতল রাখায় গাছের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকায় যে পরিমাণ সবুজায়ন আছে, আদর্শ মানের তুলনায় অনেক অল্প। উত্তর সিটি করপোরেশন দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে, এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। দুই লাখ নয়, আরও অনেক গাছ লাগাতে হবে। এর সঙ্গে পরিকল্পিত সবুজায়ন প্রয়োজন। উত্তর সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থার সবুজায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।  

তিনি বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশন যেসব গাছ ফুটপাতে রোপণ করেছে সেগুলো টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এরই মধ্যে বেশ কিছু গাছ মরে গেছে। গাছগুলো নিয়ে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাব আছে। উত্তর সিটি করপোরেশনসহ অন্য সব সংস্থা মিলে নগরের সবুজায়নের পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঠে-বাগানে বা বাড়ির আঙিনায় কী কী ধরনের গাছ রোপণ করা সম্ভব তার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনাবিদ এবং বোটানিক নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদেরও যুক্ত করা দরকার। তাদের যুক্ত না করলে ৫০ হাজার বা দুই লাখ গাছের মধ্যে তখন অল্প সংখ্যক গাছ টিকবে। ফলে তখন পরিবেশের তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগের কোনো সুফল আসবে না। এর জন্য পরিকল্পনা ও বিজ্ঞানমনস্ক বাস্তবায়নতা প্রয়োজন।  

এক প্রশ্নের জবাবে এই অধ্যাপক বলে, গাছ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোকবল লাগবে, এর কোনো বিকল্প নেই। গাছের মালিদের যদি এর মধ্যে আনা যায়, তারা সত্যিই কাজ করছে কি না, নজরদারিতে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে লোকবলের কোনো বিকল্প নেই। গাছের জন্য মালি নিয়োগ দেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত। তাদের কাজ (মালিদের) বুঝে নেওয়া ও তদারকি করতে হবে। মালির পাশাপাশি গাছগুলো যেই এলাকায় রোপণ করা হবে সেই সেই স্থানের দোকান বা ভবন মালিকদের এই কাজেও সংযুক্ত করতে হবে। কমিউনিটিকে সংযুক্ত করতে হবে, মালিনির্ভরতা দিয়ে কাজ হবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৪
এমএমআই/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।