ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বিশ্ব পরিবেশ দিবস

সংকটে ‘পাখির বাসাযুক্ত’ চা বাগানের ছায়াবৃক্ষ 

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৩ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০২৪
সংকটে ‘পাখির বাসাযুক্ত’ চা বাগানের ছায়াবৃক্ষ  গাছের খোঁড়ল থেকে উঁকি দিচ্ছে মদনা টিয়া। ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: গভীর সংকটে আজ চা বাগানের খোঁড়লপূর্ণ ছায়াবৃক্ষগুলো। দিনের পর দিন এই অবস্থা চলতে চলতে বর্তমানে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে খোঁড়লে বাসবাসকারী পাখিদের প্রজনন মৌসুম।

চা বাগানেই রয়েছে ছায়াবৃক্ষের সারি। এসব ছায়াবৃক্ষগুলোই অতি রৌদ্র ও তাপের হাত থেকে চা গাছগুলোকে রক্ষা করে থাকে। প্রতিটি চা বাগানে এক ধরনের গভীর সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় ছোট-বড় ছায়াবৃক্ষগুলোকে ঘিরেই। এগুলোকে ইংরেজিতে ‘শেড-ট্রি’ বলা হয়।  

তার থেকে বড় কথা, ওগুলোর কোনো কোনোটিতে থাকে পাখির বাসা। পাখিরা ছায়াময় বৃক্ষের খোঁড়লেই বাসা তৈরি করে। তবে সব প্রজাতির পাখি করে না, কিছু কিছু প্রজাতির পাখি করে। যে ছায়াবৃক্ষগুলো অধিকতর পুরাতন এবং খোঁড়ল অর্থাৎ গর্ত রয়েছে সেখানেই কিছু প্রজাতির পাখিদের পরম ভালোবাসার স্থান।  এমন স্থানকে ঘিরেই প্রকৃতিতে জন্ম হয় পাখির নতুন প্রজন্মের আগমন। পুরুষ ও নারী পাখিটির সংসার সুখের অপূর্ব অজানা অখ্যান।

 ‘পাখি’ মানে প্রকৃতির মাতৃময়ী নির্মাতা। আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুস্থ এবং চলমান রাখতে পাখির ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। ওরা যে ফল খায় সে ফলের বীজ থেকেই প্রকৃতি জন্মলাভ করে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ। আর এই উদ্ভিদের অসীম, অশেষ কৃতজ্ঞতার ফলেই প্রাণিকুল আজ পৃথিবীতে জীবিত।
 


কিন্তু চা বাগানের সেই ছায়াবৃক্ষের সুদিন যেন হারাতে বসেছে। বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাকৃতিক ঝড়, অতিবৃষ্টি, অপ্রয়োজনে সেই খোঁড়লযুক্ত ছায়াবৃক্ষগুলো কর্তন। চা বাগানের টিলাভূমিতে মূল্যবান গাছগাছালি একদিকে অতিবৃষ্টি ও প্রখর রোদ থেকে চা গাছকে রক্ষা করে থাকে। এক সময় চা বাগানের সেকশনগুলো কড়ই, আকাশিয়া, রেনট্রিসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছায়াবৃক্ষে ভরপুর থাকত। এখন সেভাবে ঘন হয়ে থাকা ছায়া বৃক্ষনির্ভর সেকশনগুলো কম দেখা যায়।  

চা বাগানের বিশাল বিশাল টিলার ওপর এই ছায়াবৃক্ষগুলোই মাটির ক্ষয়রোধ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। তবে একটি সংঘবদ্ধ মহল নানা কৌশলে চা বাগানের সেকশন থেকে রাতের আঁধারে এসব মূল্যবান গাছ কেটে পাচার করছে। ফলে এর মারাত্মক খারাপ প্রভাব পড়ছে চায়ের উৎপাদন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর। পাচার করা গাছের মধ্যে খোঁড়লযুক্ত গাছগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। যেখানে পাখিরা অবলীলায় বাসা তৈরি করে প্রকৃতির জন্য উপকার বয়ে নিয়ে আসতো।

চা বাগানের ছায়াবৃক্ষে বসবাস করা নানান প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে খোঁড়লে পেঁচা (Spotted Owlet), মদনা টিয়া (Red-breasted Parakeet), মোহনচূড়া বা পাতি হুদহুদ (Common Hoopoe), কাঠঠোকরা (Greater Flameback), নীলগলা-বসন্তবৌরী (Blue-throated Barbet) প্রভৃতি।

‘মদনা টিয়া’র গাছের খোঁড়লেই মধ্যেই তাদরে সংসার করে। ছোট নতুন সংসার। কিছুদিন পরই প্রকৃতিতে আসবে তাদের নতুন প্রজন্ম। কিন্তু খোঁড়লযুক্ত গাছই যদি না থাকে তাহলে তারা ছানা তুলবে কোথায়? 

একই চিত্র ‘খোঁড়লে পেঁচার’ বেলায়ও। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই ওরা রাতের আহ্বানে ডাকতে শুরু করে। কি কর্কশ ভাঙা গলার সেই ডাক! প্রাণীটি পুরোপুরি নিশাচর বলেই রাতেই তাদের শিকার ধরা এবং ডাকাডাকিময় দৌড়ঝাঁপ চলতেই থাকে।  

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশীয় চা সংসদ (বিসিবি) ও সিলেট ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র টি-প্লান্টার গোলাম মুহাম্মদ শিবলি বলেন, আমরা সবসময়ই প্রকৃতিবান্ধব। যেজন্য চা বাগানেই বেশি মাত্রায় ঘন সবুজের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। যা অন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের চা বাগানের শেডট্রির সবচেয়ে বড় শত্রু প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর কালবৈশাখী ঝড় হলেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় চা বাগানের সেকশনে। তখন ওই খোঁড়লযুক্ত গাছগুলোও অনায়াসে ভেঙে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের চা শ্রমিকদের রান্নাবান্নার জন্য জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন পড়ে। ঝড়ে কোনো গাছ মাটিতে পড়লেই যে শ্রমিক ওই গাছটি আগে দেখে কাটতে পারবে সেটি তার হবে, এমন নিয়ম চা বাগানে প্রচলিত থাকায় সেকশন শেডট্রি পড়া মাত্রই শ্রমিকরা দ্রুত গাছটিকে কেটে নিয়ে যায়। কিন্তু গাছ মাটিতে না পড়া পর্যন্ত কোনো গাছে হাত দিতে পারবে না।  

আমরা গাছ কাটতে এমনিতে নিষেধ করে থাকি। তবে খোঁড়লযুক্ত গাছের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতনতা তুলে ধরার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০২৪
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।