ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

মেঘনার অথৈ দ্বীপজলে দস্যুদের আনাগোনা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৩
মেঘনার অথৈ দ্বীপজলে দস্যুদের আনাগোনা

হাজীপুর দ্বীপ (দৌলতখান) ভোলা থেকে: মৃত্যু আর নির্যাতনের ভয় ওদের তাড়িয়ে ফেরে। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব জেলেরা জীবিকার তাগিদে মেঘনায় মাছ ধরতে পদে পদে বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন।



নদীতে দাপিয়ে বেড়ানো দস্যু বাহিনীর অত্যাচারে সর্বস্ব হারায় তারা। ধারকর্জ করে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া বিচ্ছিন্ন জনপদের মানুষগুলো আবারও নিঃস্ব হয়। জলদস্যুদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত বহু জেলে পেশা ছেড়ে অন্য কাজে ফিরছে। তারপরও ঋণের বোঝা বইতে হয় বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন হাজীপুরের যেখানেই কথা হয়, সেখানেই একই অভিযোগ। মেঘনা দাপিয়ে বেড়ানো শক্তিশালী অস্ত্রধারী কয়েকটি দস্যু বাহিনীর কাছে জিম্মি ভোলার দৌলতখানের দ্বীপ ইউনিয়ন গাজীপুরের হাজারো জেলে।

চারদিকে মেঘনা নদী বেষ্টিত এ দ্বীপের প্রায় শতভাগ মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও কেবল জলদস্যুদের অত্যাচারেই তাদের সেদিন ফুরিয়ে এসেছে। বছরে বছরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বারবার মুক্তিপণ দিয়ে নিঃস্ব হয়ে জেলেরা এখন দিশেহারা।

জলদস্যুদের হাতে নির্যাতনের শিকার অসংখ্য জেলে। হাজীপুরের চর নলডগী বৈকুণ্ঠপুর বাজারে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় দস্যুদের নির্যাতনের শিকার জেলেদের নামের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে।
এক বা একাধিকবার জলদস্যুদের কবলে পড়া জেলেরা একে একে জানালেন সেই লোমহর্ষক কাহিনী। চাঁদা না দিলে নদীতে মাছ ধরা যাবে না। এটাই জলদস্যুদের আইন। জেলেদের অভিযোগ, প্রশাসন আর পুলিশ বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে এরা রাতে-দিনে জেলেদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে।

খোঁজ নিয়ে বহু জেলের দস্যুর কবলে পড়ার কাহিনী জানা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর হাজীপুরের জাকির হোসেন ও আলাউদ্দিনের মাছধরা ট্রলার ডাকাতের কবলে পড়েছিল বুধবার। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ওই ট্রলার নিয়ে এসেছেন মালিকেরা।

ট্রলার দুটো প্রকাশ্য দিনের বেলায় নিয়ে যায় ডাকাতরা। জেলেদের চরে নামিয়ে দিয়ে ট্রলার আটকে রেখে তার মুক্তিপণ হিসেবে চাঁদা দাবি করে।

মেঘনা নদীতে রাতে আয়াত হোসেনের ট্রলারে থেকে ৯ জন জেলে মাছ ধরছিলেন। জলদস্যুরা ট্রলারটি আটক করে সব জেলেকে মারপিট করে চরে নামিয়ে দেয়। ট্রলারের মাঝিকে আটক করে মুক্তিপণ দাবি করে। তাকে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। একই সময়ে ফিরোজ খন্দকার, আবদুল মান্নান এবং আরও পাঁচ জনের পাঁচটি ট্রলার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এসব ট্রলারও মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়াতে হয়।

দু সপ্তাহ আগে শরিফ মাঝির ট্রলারে জলদস্যুদের হামলা হয়। এর আগে তার ট্রলার দু’বার আক্রমণের শিকার হয়। শেষবার মাঝিকে জলদস্যুরা নিয়ে যায়। তিন বারে মুক্তিপণ হিসেবে দস্যু বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা।

জসিম মাঝির মাছধরা ট্রলারও ডাকাতে নিয়েছে। এতে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ছিল। একই সময়ে নুরুন্নবী মাঝির আরও একটি ট্রলার নিয়ে যায় ডাকাতরা। মুক্তিপণ দাবি করা হয় এক লাখ টাকা।

আড়তদারদের কাছ থেকে জসিম পৌনে তিন লাখ আর নূরুন্নবী আড়াই লাখ টাকা দাদন নিয়ে মাছ ধরতে নেমেছিলেন। জলদস্যুরা ট্রলার নিয়ে যাওয়ায় এখন ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

হাজীপুর লাগোয়া চর জহিরুদ্দিনের জেলেদেরও একই অভিযোগ। সেখানকার মলনচোরা বাজারের ব্যবসায়ী জামাল ভাণ্ডারী বলেন, মাস দেড়েক আগে বাজার থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ৮ লাখ টাকার ইলিশ নিয়ে বরিশালে যাচ্ছিল একটি ট্রলার। বাজারের মোহনা থেকে বের হওয়া মাত্রই ট্রলারটি ডাকাতের কবলে পড়ে।

জেলেদের অভিযোগ, হাজীপুর দ্বীপের প্রধান সমস্যা জলদস্যুদের অত্যাচার। গত তিন-চার বছর ধরে এ অত্যাচারের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। জলদস্যুরা মেঘনা নদীর এক একটি এলাকা দখল করে রেখেছে।
নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোনো জেলে জলদস্যুদের চাঁদা না দিয়ে মাছ ধরতে পারে না। চাঁদা সংগ্রহের জন্য আবার আছে টোকেন পদ্ধতি। চাঁদা পরিশোধের টোকেন দেখাতে পারলে জলদস্যু বাহিনী মাছধরা ট্রলার আটক করবে না। টোকেনের মেয়াদ থাকে একমাস।

সূত্র বলছে, সময়ের বিবর্তনে জলদস্যুদের মুক্তিপণ লেনদেনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল ব্যাংকিং এক্ষেত্রে অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। জেলেদের ধরে নিয়ে মোবাইল নম্বর দিয়ে ব্যাংকিং অথবা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়। দরকষাকষির মাধ্যমে জেলেরা সাধ্য অনুযায়ী মুক্তিপণ দিয়ে ট্রলার মুক্ত করে আনে। অনেকে আবার ট্রলার মুক্ত করতেই পারেন না।

জেলেদের অভিযোগ, জলদস্যুরা প্রশাসন কিংবা পুলিশ বাহিনীকে তোয়াক্কা করে না। জলদস্যু আর পুলিশের সঙ্গে আঁতাত আছে বলে মনে করেন তারা। যখন জলদস্যুরা নদীতে থাকে তখন পুলিশ অভিযানে নামে না। আবার পুলিশ এমন সময়ে অভিযানে নামে যাতে জলদস্যু নদীতে না থাকে।

অন্যদিকে, জলদস্যুদের তৎপরতার কথা কোস্টগার্ডকে জানালে তারা ভ্রুক্ষেপ করে না। তবে পুলিশ ও কোস্টগাডের নিজস্ব টহল চলে। তখন জলদস্যুদের নদীতে দেখা যায় না। নির্বিঘ্নে মাছ ধরার সুবিধার্থে দ্বীপ হাজীপুরের জেলেরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোর তৎপরতা প্রত্যাশা করেন।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাজীপুরের জেলেদের ওপর হামলাকারী জলদস্যুদের বাড়ি ভোলার তজুমদ্দিন ও নোয়াখালীতে। তজুমদ্দিনের কামাল বাহিনী এবং নোয়াখালীর স্বপন বাহিনী নামে কাজ করে এরা। এ ছাড়া হাতিয়া ও সন্দ্বীপের কিছু ডাকাত বাহিনী এ এলাকার জেলেদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করে।

অপরদিকে, ‘দোয়েল’ প্রতীক নিয়ে তজুমদ্দিনের সোহেল পাটোয়ারী ও নোয়াখালীর গজারিয়ার বেলাল চেয়ারম্যান বলে পরিচিত এক ব্যক্তি জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। দৌলতখান, রমগতি ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় দোয়েল প্রতীকের পতাকা আছে।

হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এ দ্বীপে জলদস্যুদের আক্রমণই সবচেয়ে বড় সমস্যা। এর সমাধানে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
 
স্থানীয় লোকজন বলেন, ভৌগোলিক কারণে দ্বীপ হাজীপুর জলদস্যুদের সুনজরে। এ দ্বীপের চারদিকে মেঘনার অথৈ জলরাশি। চারদিকেই দস্যুদের আনাগোনা। এ কারণে সহজেই দস্যুরা আক্রমণ করতে পারে। নদীবেষ্টিত হওয়ায় দস্যুদের হাত থেকে জেলেদের পালাবারও কোনো উপায় থাকে না। কারণ জেলেরা এ চরেই পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে।

জলদস্যু দমন প্রসঙ্গে ভোলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশের জোরালো অভিযান চলছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু জলদস্যু নিহত হয়েছে। বেশ কিছু দিন থেকে ভোলা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান চালানো হচ্ছে।

পুলিশের সঙ্গে দস্যুদের যোগসাজশের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, মেঘনা জলসীমায় দস্যুদের উৎপাতের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তিনটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আরও ৬টি কেন্দ্রের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।

Rafiqul-islamকোস্টগার্ডের ভোলা দক্ষিণ জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন সেলিম রেজা হারুন দস্যু দমনে কোস্টগার্ড সদস্যদের গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। জেলেদের নিরাপত্তায় এ বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত আছে বলেও তিনি জোর দাবি করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৩১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৩
আরআইএম/এইচএ/এসএইচ/পিসি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।