ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

পূর্বপুরুষের জমির ওপর অন্যের থাবা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৩
পূর্বপুরুষের জমির ওপর অন্যের থাবা

উপকূল ঘুরে এসে : জমি জালিয়াতির প্রসঙ্গ তুলতেই গ্রামের চায়ের দোকানে বেশকিছু মানুষের ভিড় জমে। দূর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে এগিয়ে আসেন উৎসুক আরও কয়েকজন।

এভাবে জটলা ক্রমেই আরও বড় হতে থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে একেক জন মানুষ ভিড় ঠেলে সামনে এসে অভিযোগ জানাতে ব্যস্ত।

এই জটলা দেখে থেমে যায় যানবাহনও। মানুষগুলোর একটাই কথা ‘পূর্বপুরুষের জমি হাতছাড়া হতে দেব না। আমাদের জমি আমরা ফিরে চাই। ’

ভোলা সদর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে ভেলুমিয়া এলাকায় ভূমিদস্যুদের কবলে পড়া মানুষগুলোর আকুতির ভাষা এমনই। বাপ-দাদার আমল থেকে ভোগ-দখলে থাকা বাড়িঘর, পুকুর, সুপারি বাগান, ধানক্ষেত সবই ‘ভুয়া নিলামের’ মাধ্যমে বেদখলের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

জমি রক্ষায় শুধু পুরুষেরা নয়, নারীরাও আন্দোলনে নেমেছেন। সমাবেশ আর মানববন্ধন করেছেন। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এরইমধ্যে ভূমিদস্যু দলের প্রধান জাকির পাটোয়ারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তারপরও নিজেদের ভূমি সুরক্ষার নিশ্চয়তা পাচ্ছে না এলাকাবাসী। গ্রাম ঘুরে বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে সেটাই মনে হলো।

upkulকুঞ্জপট্টি গ্রামের ফিরোজ কবির জানান, তার নিজের নামে কুঞ্জপট্টি মৌজার ১৮ নম্বর খতিয়ানে ৫৬ শতাংশ এবং ৯০ নম্বর খতিয়ানে ১২ শতাংশ জমি বাপ-দাদার আমল থেকেই ভোগ-দখল করছেন। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ভূমিদস্যু চক্র ওই জমি ভুয়া নিলাম দেখিয়ে অন্য নামে বণ্টনের পাঁয়তারা করলে কোর্টে বিষয়টি ধরা পড়ে। এর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা হয়েছে।

আরেকজন চরগাজীর তাজুল ইসলাম। তিনি জানালেন, চরগাজী মৌজায় ১৯৭ নম্বর খতিয়ানে তার ২৪ একর ৭২ শতাংশ জমি প্রায় ৩০ বছর ধরে ৩৩টি পরিবারের দখলে রয়েছে। এই জমি ৫৩ সালের ভুয়া নিলাম হয়েছে বলে ভোলা জজকোর্টে একতরফা মামলা করে ডিক্রি নেয়া হয়েছে। মামলা হয় ২০০৯ সালে, আর ডিক্রি করা হয় ২০১১ সালে।

চন্দ্রপ্রসাদ মৌজার মো. ফোরকান জানালেন, ৩৮৯ নম্বর খতিয়ানের পাঁচটি দাগে থাকা তার প্রায় দেড় একর জমি বেদখলের পাঁয়তারা চলছে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রেকর্ডীয় এই জমিতে আটটি ঘর রয়েছে। গাছপালা, পুকুর, সানবাঁধানো ঘাট, উঠান, সবই আছে, কিন্তু এ জমি মালিকদের হাতছাড়া হওয়ার পথে।

এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সবার মুখেই একই অভিযোগ। ভেলুমিয়া বাজার থেকে কুঞ্জপট্টি গ্রামে যাওয়ার পথে রিকশা থামিয়ে অভিযোগ জানালেন বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়া সেরাজুল হক জোমাদ্দার। তার মালিকানায় থাকা কুঞ্জপট্টি মৌজার নম্বর খতিয়ানের প্রায় ৩২ শতাংশ জমি বেহাত হওয়ার পথে। এই জমিতে বাড়ি, চাষের জমি আর পুকুর রয়েছে। জীবনের এই বয়সে এসে সারাজীবন ধরে ভোগ করা এই জমি সুরক্ষা নিয়ে তিনি চিন্তিত।

পিচঢালা সদর রাস্তা থেকে এঁকেবেঁকে একটি সড়ক চলে গেছে কুঞ্জপট্টি গ্রামের ভেতরে। পাশে ছোট্ট খাল, ঝোপঝাড়, কিছু কাঁচা-পাকা বাড়ি, ফসলি ক্ষেত। এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, এই গ্রামের দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ জমি জালিয়াত চক্রের শিকার। কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন এই জমি। এটুকু বেহাত হলে এই মানুষগুলোকে পথে বসতে হবে।

গ্রামের লোকজন জানালেন, জমি জালিয়াতির খবর জানতে পেরে গত রোজার ঈদের পরে এলাকার মানুষ আন্দোলনে নামেন। ভূমিদস্যু চক্রের লোকজন গ্রামবাসীর মাঝে প্রচার করতো, ‘তোমাদের জমি নিলাম হয়েছে। ঝামেলা মিটিয়ে দেবো। এজন্য টাকা দিতে হবে। ’ এই খবর পেয়ে গ্রামবাসীর টনক নড়ে।

চলতি বছরের ১৭ আগস্ট গ্রামের অনেকে তহসিল অফিসে গিয়ে বিষয়টি জানতে গিয়ে দেখেন বিভিন্ন নামে ২৫ একর জমি নিলাম করে কোর্টে চারজনের নামে বন্টননামা করা হয়েছে। এভাবেই গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একে একে অনেকেই খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ভুয়া কাগজ তৈরি করে জমি নিলামের পাঁয়তারা চলছে। upkul         

ভেলুমিয়া বাজারে ভূমিদস্যু প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনেকেই ছুটে আসেন অভিযোগ জানাতে। পূর্বপুরুষ থেকে জমির খাজনা দিয়ে এলেও অনেকেই জমি সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত। কুঞ্জপট্টি, চরগাজী, বাঘমারা, টুনচর, চর নোয়াবাদ, চন্দ্রপ্রসাদসহ আশপাশের এলাকার প্রায় দুই হাজার মানুষের জমি জালিয়াতির অপচেষ্টা চলছে। শুধু কুঞ্জপট্টি মৌজায় ২৫ একর জমি ভুয়া নিলাম এবং ১৩শ’ একর জমি ডিক্রি করা হয়েছে।

সূত্র বলছে, কুঞ্জপট্টি গ্রামের বাসিন্দা জাকির হোসেন পটোয়ারী নামের ব্যক্তির নেতৃত্বে জমি জালিয়াতির তৎপরতা চলছে। এদের সহযোগী হিসাবে আরও রয়েছে আশাপাশের এলাকার মো. শাহজাহান, মজু মাতব্বর, আবদুস সাত্তার, জাহাঙ্গীর আলম খান, নূরে আলম রাজু, আনোয়ার হোসেন, রফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকে। এলাকাবাসী জাকির হোসেন পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে ৯টি মামলা করেছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়ে আছে। তবে এলাকাবাসীর ভূমি সুরক্ষার কোনো ফয়সালা হয়নি।

ভেলুমিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে জমি দখলের পাঁয়তারা করছে জাকির হোসেন পাটোয়ারী নামের এক ব্যক্তি। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার এ ধরনের কাজ করা ঠিক হয়নি।

ভেলুমিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মাল বাংলানিউজকে বলেন, জমি জালিয়াতির অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। তবে অনেকেই নিজেদের জমি রক্ষার জন্য আদালতে গেছেন। সেখান থেকেই তাদের জমির মালিকানা বুঝে পাবেন।  
 
বাংলাদেশ সময়:  ০৩৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৩
আরআইএম/এসএফআই/এনএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।