ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

আশ্বিনের আগন্তুক ‘তাইগা-চুটকি’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৭
আশ্বিনের আগন্তুক ‘তাইগা-চুটকি’ ‘তাইগা-চুটকি’, প্রজনন মৌসুমে পুরুষের গলায় হলদে রঙ হয়, ছবি : ইনাম আল হক

মৌলভীবাজার: এই আশ্বিনেই এসে গেছে ছোট্ট পাখিটি। একটু একটু করে সুদূরের পথ পাড়ি দিয়ে তার আগমন ঘটেছে বাংলার সবুজ প্রকৃতিতে। এখানেই কোমল মায়ায় জুড়াবে তার প্রাণ, প্রতিটি পালক।

যে সকল পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে দীর্ঘদিন অবস্থান করে তাদের মধ্যে অন্যতম ‘তাইগা-চুটকি’ (Taiga Flycatcher)। আমাদের দেশে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে একেবারে মে মাস পর্যন্ত প্রায় ৯ মাস অবস্থান করে এরা।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন অবস্থান করা হাতেগোনা পরিযায়ীদের তালিকায় তাইগা-চুটকি অন্যতম।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক পাখিটির নামকরণ সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, “এই‘তাইগা’ নামকরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গেলে একটু ব্যাখ্যা দিতে হবে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের তীব্র শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি ‘তুন্দ্রা’ এবং অপরটিকে ‘তাইগা’। তুন্দ্রা’র অর্থ হলো প্রচন্ড ঠাণ্ডা এলাকা; যেমন সাইবেরিয়া। এখানে মাত্র ৩ মাস বরফ থাকে না, বাকি ৯ মাস  পুরোপুরি বরফে আবৃত থাকে। ফলে এখানে কোনো বড় গাছপালা জন্মায় না, ছোট ঝোপঝাড় হয়। মাত্র তিন মাসে এই এলাকার মাটি গরম হতে পারে না। এটাকে বলা হয় ‘পার্মাফ্রস্ট’ অর্থাৎ চিরকালের জন্য ঠাণ্ডা। ”গাছের ডালে আপন মনে বসে রয়েছে ‘তাইগা-চুটকি’, ছবি : ইনাম আল হক

“তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে যদি দক্ষিণের দিকে আসতে থাকেন তখন দেখা যাবে গাছগুলো ধীরে ধীরে বড় বড় দেখাচ্ছে। কারণ, এখানে মাত্র ৫ মাস বরফ থাকে। বাকি সময় বরফ থাকে না। এই অঞ্চলকে বলা হয় তাইগা। তুন্দ্রায় কোনো বড় গাছপালা নেই। কিন্তু তাইগাতে বড় গাছপালা হতে পারে। কারণ মাটি এখানে কিছু দিনের জন্য গরম থাকে।  তাই মাটি থেকে রস আহরণ করে গাছগুলো বড় হবার সুযোগ পায়। ”

পাখিটি ডিম পাড়তে তাইগা অঞ্চলে যায় বলে এই পাখিটার নামকরণ করা হয়েছে ‘তাইগা-চুটকি’।

তাইগা অঞ্চলে বিশেষ এক ধরণের গাছ হয়। ওটাকে বলা হয়‘কর্নিফার’। পাতাগুলো চওড়া হয় না। খুব চিকন চিকন সুঁইয়ের মতো পাতা হয়। বরফের নিচে থাকলেও পাতাগুলো দিব্বি বেঁচে থাকতে পারে। এই কনিফার গাছে এই পাখিটি বাসা করে বলে একে তাইগা-চুটকি বলা হয়। ”

পাখিটির প্রাপ্তি সম্পর্কে ইনাম আল হক বলেন, “এই পাখিটিকে আমাদের দেশে একেবারে মে মাস পর্যন্ত দেখা যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে এই পাখিটিকে আপনি আপনার শহরেও এখন খুঁজে পাবেন। গাছের ডালে ডালে-ঝোপঝাড়ে বা শহরেও পাওয়া যায়। মে মাসের মাঝামাঝিতে বা শেষের দিকে ওরা উড়ে আবার তাইগা অঞ্চলে চলে যায়। আবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চলে আসে। মাত্র তিন সে তাইগা অঞ্চলে থাকে। এই তিন মাসেই বাসা তৈরি করে ডিম পাড়া, ছানা ফুটানো এসব খুব দ্রুতই করে ফেলে ওরা। ”

পাখিটির খাবার প্রসঙ্গ তিনি বলেন, “রাস্তার পাশে কড়ই গাছের ডালে-পাতায় যে সব পোকা হয় ওগুলো খেয়েই ওরা দিব্বি বেঁচে থাকতে পারে। ও যেহেতু একটি বিশেষ ধরণের পোকা ধরে খায়, তাই ওই গাছে সে অন্য কোনো তাইগা-চুটকিকে আসতে দেয় না। পাতাহীন ডালে বসে থাকে এবং পোকাকে দেখলেই দ্রুত উড়ে এসে ধরে কিংবা অনেক সময় পোকা নিচ থেকে খুটেও খায়। গাছের ছোট্ট ছোট্ট সাদা পোকাসহ অন্য পোকাও তার বিশেষ খাবার। ”পোকার সন্ধানে অপেক্ষমান ‘তাইগা-চুটকি’, ছবি : ইনাম আল হক

পাখিটিকে চেনার উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই পাখিটি টুনটুনির চেয়ে ছোট। ‘চিরিক-চিরিক’ করে ডাকে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ সেন্টিমিটার। বাদামি দেহ। মাথা, পিঠ, ডানা ও লেজ ধুসর। কোমর কালো। খাবার সময় সে দোয়েলের মতো ওর লেজটি একটু পরে পরে পিঠের উপর বারবার উঠায়। ওর চোখগুলো অপেক্ষাকৃত বড় বড়। বেশ চঞ্চলপ্রকৃতির। এর ডানা দু’টো সাধারণত লেজের নিচে নামানো থাকে। অন্যপাখির ডানা কিন্তু লেজের সমান্তরাল থাকে। ডালে বসলে ওর ডানাগুলো লেজের নিচে ঝুলিয়ে রাখে। ”

“আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, পুরুষ পাখিটির গলায় প্রজনন মৌসুমে হালকা কমলা রঙ হয়। আমাদের দেশে ওরা যখন আসে তখন আর সেই রঙটি থাকে না। কিন্তু আশ্বিনে আমাদের দেশে আসলেও কোনো কোনো পুরুষ পাখির গলার ওই কমলা রঙের পালকগুলো ঝরে যায় না, অনেক সময় থেকে যায়। তখন খুব সহজে বোঝা যায় এটি পুরুষ তাইগা-চুটকি। যদিও অন্য চুটকি প্রজাতির পাখির সাথে ‘তাইগা-চুটকি’র কিছুটা মিল আছে। কিন্তু অন্য প্রজাতির চুটকিগুলো খুবই কম দেখা যায়। বেশি দেখা যায় এই ‘তাইগা-চুটকি’। ”

‘তাইগা-চুটকি’ আমাদের জন্য বিশেষ একটি পাখি এই জন্য যে এরা আমাদের দেশে দীর্ঘ ৯  মাস অবস্থান করে এবং এদের সংখ্যা লাখ লাখ। কিন্তু এই পাখিটিকে কেউই চেনে না। গ্রামে-গঞ্জে তো আছেই, প্রতিটি শহরেও এরা আছে। লোকে এ পাখিটাকে ভুল করে‘টুনটুনি’ভেবে ধরে নেয় বলে জানান প্রখ্যাত পাখিবিদ ইনাম আল হক।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩১ ঘণ্টা, ৩ অক্টোবর, ২০১৭
বিবিবি/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।