ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

মৃদু সুগন্ধিযুক্ত দুর্লভ ফুল ‘নাগলিঙ্গম’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৯
মৃদু সুগন্ধিযুক্ত দুর্লভ ফুল ‘নাগলিঙ্গম’ সুগন্ধিযুক্ত দুর্লভ ফুল নাগলিঙ্গম। ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: ফুলটি বড় আকারের ফণাযুক্ত। পরাগচক্র দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। তবে একটি-দু’টি নয়, দীর্ঘদেহী গাছের নিচে ছোট ছোট ডালের সঙ্গে অনেকগুলো ফুল ফোটে। গোলাপি আর হালকা হলুদের অপূর্ব সংমিশ্রণ তাতে।

ছয়টি পাপড়িতে দারুণ সৌন্দর্যময়ী সে। তবে ফুলগুলো কিন্তু ফুটে রয়েছে গাছের গুঁড়িতে।

আকরে বেশ বড় বড়। একটি মৌমাছি প্রতিটি ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহের নেশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই ফুলগুলো থেকে ভেসে আসছে অপূর্ব মৃদু সুগন্ধি। সেই সুগন্ধিতে জুড়িয়ে যায় মনপ্রাণ।

সুগন্ধিযুক্ত দুর্লভ ফুল নাগলিঙ্গম।  ছবি : বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন প্রখ্যাত উদ্ভিদ গবেষক ও লেখক দ্বিজেন শর্মা নাগলিঙ্গম প্রসঙ্গে তার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন, ‘আপনি বর্ণে, গন্ধে, বিন্যাসে অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। এমন আশ্চর্য ভোরের একটি মনোহর অভিজ্ঞতা অনেক দিন আপনার মনে থাকবে। ’

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ফুলটি যখন ফোটে তখন সাপের ফণার মতো দেখতে লাগে। এ অনুসারেই তার নামকরণ হয়েছে নাগলিঙ্গম। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ আল হোসেন বিটিআরআই ক্যাম্পসে এই নাগলিঙ্গমের চারাটি রোপণ করেছিলেন।

বিটিআরআই’র মালি বাবুলাল মাঝি বাংলানিউজকে বলেন, বছরের দু’বার ফুল আসে। তবে বসন্তকালে বেশি। ফাল্গুন মাসের শুরুতে গাছের সব পাতা পড়ে নতুন পাতা গজায়।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর ‘ক্রপ প্রডাকশন ডিপার্টমেন্ট’ (উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং কীটকৃষি তত্ত্ব বিভাগ) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) মো. ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, নাগলিঙ্গম বা হাতির জোলাপ একপ্রকার বৃক্ষ জাতীয় দুর্লভ উদ্ভিদ। এই গাছের ইংরেজি নাম 'Cannonball tree' এবং বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis; যা Lecythidaceae পরিবারভুক্ত।

এর আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চল। এটি খুবই বিরল প্রজাতির একটি গাছ। সমস্ত পৃথিবীতে এই উদ্ভিদটি বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশে প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, ‘বলধা গার্ডেন, রমনা পার্ক, টঙ্গী, বরিশালের বিএম কলেজ, ময়মনসিংহের মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জলটঙ্গী পুকুর ঘাটের পূর্বপাশে, গফরগাঁও সরকারি কলেজ, গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিটিউটসহ সারাদেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি গাছ রয়েছে। ২০ বছর আগে এক বৃক্ষ জরিপে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন বাংলাদেশে ৫২টি নাগেশ্বর বৃক্ষ আছে। বাংলাদেশে নাগলিঙ্গম গাছের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন জার্নালে ঢাকা শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি, বলধা গার্ডেনে একটি, সিলেট ও হবিগঞ্জে একটি করে নাগলিঙ্গম গাছ থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। ’

বিটিআরআই এর মালি বাবুলাল মাঝি।  ছবি : বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনউদ্ভিদবিজ্ঞানী ইসমাইল হোসেন ফুলের বৈশিষ্ট্য ও প্রজাতি সম্পর্কে বলেন, নাগলিঙ্গম ৩৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গুচ্ছ পাতাগুলো খুব লম্বা, সাধারণভাবে ৮-৩১ সেন্টিমিটার, কিন্তু ৫৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বায় পৌঁছাতে পারে। এর উদ্ভিদের ৩টি প্রজাতি রয়েছে। এদের নাম: নাগেশ্বর, নাগকেশর ও নাগলিঙ্গম। বৃক্ষের পাতার রং গাঢ় সবুজ। শাখা-প্রশাখায় কোনো ফুল ফোটে না। বহুদূর থেকে ফুলের সুবাস পাওয়া যায়। এর ফুল উজ্জল গোলাপি, পাপড়ি গোলাকার কুণ্ডলি পাকানো। ফুটন্ত ফুলের পরাগ কেশর সাপের ফণার মতো। আর এ কারণেই গাছটির নাম ‘নাগলিঙ্গম’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ফুলের সুবাস তীব্র নয়। সারা গ্রীষ্মকাল ধরেই নাগলিঙ্গম ফুল ফোটে। এই গাছে ফুল ধরার পর বেলের মতো গোল গোল ফল ধরে। এগুলো হাতির খুবই প্রিয় খাবার। এজন্য এর অন্য নাম হাতির জোলাপ গাছ।

জনশ্রুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, হাতির পেটের অসুখের প্রতিষেধক হিসেবে ওই গাছের কচিপাতা কার্যকর ভূমিকা রাখতো বলে জানা যায়। গাছের কাণ্ডে ফুল ফোটে। ফলের গায়ের রং সফেদার মতো। বাংলাদেশের অনেকেই গাছটির ফল সংগ্রহ করে এর বীজ থেকে চারা উৎপাদনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো চারা গজায়নি। ফলের ওজন প্রায় ২ কেজি। দেখতে সুন্দর হলেও ফলের স্বাদ খুবই তিক্ত। পশু-পাখিও এই ফল খায় না। দুর্লভ নাগলিঙ্গম গাছের ব্যাপক ওষুধি গুণ রয়েছে। ’নাগলিঙ্গম বৃক্ষ।  ছবি : বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনউদ্ভিদবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, নাগলিঙ্গম ফুলের কলি দিয়ে রস তৈরি করে খাওয়ালে প্রসূতির সন্তান প্রসব সহজ হয়। এর মাঝবয়সী পাতা দিয়ে তৈরি পেস্ট দাঁতের পাইরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যাপক কার্যকর। এ গাছের বাঁকল দিয়ে বহুমূত্র রোগের ওষুধ তৈরি করা হয়। এ গাছের কাঠও অত্যন্ত মজবুত। লালচে বাদামি রঙের এ কাঠ রেলের স্লিপারসহ ভারী কাজে লোহার পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। এত সব গুণ থাকা সত্ত্বেও শুধু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এ দেশে নাগলিঙ্গম গাছের বিস্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিক নিয়মে বীজ থেকে চারা উৎপন্ন হওয়ার কথা থাকলেও প্রচণ্ড উঞ্চ অঞ্চলের গাছ বলে এ গাছের বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম এ দেশে হয় না।

এ বৃক্ষের ফুল, পাতা ও বাঁকলের নির্যাস এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল ও এন্টিসেফটিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পেটের পীড়া দূরীকরণে এর জুড়ি নেই। পাতা থেকে উৎপন্ন রস ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে খুবই কার্যকর। এছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকায় এর পাতা ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে থাকে। ফলের শক্ত খোলস অলংকার বা বিভিন্ন দ্রব্য বহনে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত এই উদ্ভিদটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক বলে জানান বিটিআরআই এর উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইসমাইল হোসেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৯
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।