গ্রিক মাইথোলজির নার্সিসাসের গল্প আমরা সবাই জানি, সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে আত্মমুগ্ধ হওয়ার ফল ক্ষয়। সেখানেও বিষয়টি ছিলো ছবি, প্রতিবিম্ব! প্রাচীন যুগের প্রাসঙ্গিকতায় নিজের ছবি দেখতে মানুষ জলই ব্যবহার করত; এর পূর্বে কোনো এক পর্বে কাচ সম্পর্কিত আলোচনায় সে কথা লিখেছিলাম।

২০১৪ সালটিকে সেলফির বছর বলা হয়। সেলফি সংক্রান্ত আশ্চর্য ঘটনা এই বছরগুলোতে ঘটেছে। এক উড়োজাহাজ চালক তার সঙ্গীদের নিয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকায় দুর্ঘটনা ঘটান। ব্রিটেনের ১৯ বছরের এক যুবক এই সেলফাইটিস তথা সেলফির দ্বারা আসক্ত হয়ে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। প্রথম প্রথম সে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করত, সেখানে কিছু সন্তোষজনক মন্তব্য না এলে সে আবার ভালো সেলফি তোলার চেষ্টা করত। পরবর্তীতে সে দিনে ১০ ঘণ্টা সেলফির জন্য ব্যয় করত কারণ, তার মনে হতো কোনো ছবিই তার ভালো উঠছে না। নিজেকে নিজের মতো ছবিতে না পেয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আরও অজস্র ঘটনা, বিশেষত এই ঘটনার পর মনোবিদরা মনে করেন এটি একটি রীতিমতো ডিসঅর্ডার বা বিক্ষেপ, এর সঙ্গে চরিত্র বা মূল্যবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা জৈবভাবে একটি খারাপ অবস্থা তৈরির সূচনাপর্বের আসক্তি। এমনিতেও ফোনের তরঙ্গধর্মী আলো ত্বকের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে অনেকে মনে করেন। তবে মানসিক আসক্তির ক্ষমতা যেহেতু ব্যক্তির দ্বারা বোধের উন্মেষ ঘটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাই এটা হাতের বাইরে গেলে মহামারীর মতো বিপদ। আসলে আমাদের মস্তিষ্ক খুব একটা একাধিক কাজে সচল ও সফল নয় একই সময়ে। ফলস্বরূপ মস্তিষ্ক কোনো কাজে নিযুক্ত হলে ইচ্ছের সাপেক্ষে তার মধ্যে ব্যস্ত থাকে। ঠিক এই কারণে গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলতে না করা হয়! কিন্তু সেলফির বিষয় আরও গুরুতর, লোকে সাধারণতভাবে এ নিয়ে এতো কথার কী আছে আমার ফোন, আমার ইচ্ছে— খুব সাধারণ একটা ব্যাপার কিন্তু কখন এই ঘোরটা চলে আসে মানুষ নিজেই জানে না। যখন অন্য কেউ আমার ছবি তুলে দিচ্ছে আমিও তার অবস্থান দেখছি, সেও আমার অবস্থান দেখছে ফলে প্রথমত অবস্থানটা আপেক্ষিক নিরাপদ; দ্বিতীয়ত দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে আমি আমার আবেগ, আমার মুহূর্ত জমা রাখছি তার জিম্মায়— এই তার চোখ দিয়ে নিজেকে দেখা একটা স্থিতধী ভাব ও নির্ভরতার ভাব আনছে। এবার ব্যক্তি যেই নিজে ছবি তুলছে তার চোখ তার মন, তার মুখ এই তিনটির তৃপ্তির পরিভাষা দিয়ে সে ছবি তোলার চেষ্টা করে ফলে সর্বদাই ‘আরও ভালো’ বিষয়টা গুরুতর হয়। নিজের ভালো-মন্দ নিজে দেখার ফলে ব্যক্তি ‘আমি’ সম্পর্কে অতিসচেতন হয়, আমি ভিন্ন আর কোনো বিষয়েই তার অনুভূতি থাকে না। ক্যামেরা, সে ও তার মুহূর্তের আবেগ এখানে সমষ্টিগতভাবে আমিকেই মস্তিষ্কে প্রখর করে তোলে। আরও বিষয় ব্যক্তি সর্বদাই ভাবে, আহা এটা সাপ নয় সেলফি। এই নিরাপত্তাবোধ আরও বিপজ্জনক এবং যারা অঘটন ঘটাচ্ছে তারা বোকা, ‘আমি’ নই; এই ভাবনাও সেই একই পথের।

ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের হাতের জিনিস আমাদেরই অধিকারে থাকা যে এমনিতে নির্দোষ, আচরণের কারণে তা আমাদের ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেলফি অবশ্যই তুলব, তাকে উপভোগও করব কিন্তু এরকম যেনো না হয় যে, সেলফি আমাদের জীবন নিয়ে যায়! সেলফির মূলগত বিষয় “সেলফ পোট্রেট” তথা নিজস্ব ছবি নির্মাণ। ১৮৩৯ সালে যখন আমরা এতোটাও যান্ত্রিক হয়নি, সেই সময় থেকেই মানুষ এর সঙ্গে পরিচিত ছিলো। ফোটোগ্রাফির ইতিহাসেও এর নমুনা পাওয়া যায়। কিন্তু এরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এ ছিলো কল্পনার বাইরে!
তবে এখানে মানুষের চরিত্রে গঠনগত দিক দিয়ে এসব দুর্ঘটনাকে বিচার করলে এর কারণ কিছুমাত্র হলেও আত্মকেন্দ্রিক; এই ভাবনার ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়াকে অবশ্যই ধরতে হবে। সেলফি মুখ্যতই সেলফিশ।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত কমবেশী, তার একটি লাইন এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, “THE BEST PORTION OF GOOD MAN’S LIFE IS HIS LITTLE NAMELESS, UNREMEMBERED ACTS OF KINDNESS AND OF LOVE”।
অড্রে হেপবার্ন বলেছিলেন, “FOR BEAUTIFUL EYES, LOOK FOR THE GOOD IN OTHERS; FOR BEAUTIFUL LIPS, SPEAK ONLY WORD OF KINDNESS; AND FOR POISE, WALK WITH THE KNOWLEDGE THAT YOU ARE NEVER ALONE”।
আর আমরা সব ভুলে কিনা সেলফিতে সমর্পিত কিন্তু আর এই ঘোরের আড়ালে থাকা ঠিক নয়; সেলফি আমাদের অধীনে থাকুক, আমরা যেনো সেলফির অধীনে না আসি— না হলে ধীরে ধীরে এটা শুধু প্রাণনাশ নয় অন্য আরও খারাপ সম্ভাবনার পথ করে দেবে!
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৭
এসএনএস