ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ফরিদপুরের হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বার অস্ত্রোপচারে ‘অতিরিক্ত বিল’ নেওয়ার অভিযোগ

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩
ফরিদপুরের হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বার অস্ত্রোপচারে ‘অতিরিক্ত বিল’ নেওয়ার অভিযোগ

ফরিদপুর: ফরিদপুর শহরে ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি নামক একটি হাসপাতালে জান্নাতি বেগম (২০) নামে অন্তঃসত্ত্বার অস্ত্রোপচারের বিল করা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৫৩ টাকা। এটিকে ‘অতিরিক্ত বিল’ বলছেন জান্নাতির স্বামীসহ স্বজনরা।

তারা বলছেন, এই বিলের পাশাপাশি ওই নারীর অস্ত্রোপচারের ওষুধ কেনার টাকাও তাদের বহন করতে হয়েছে।

তিন দিন হাসপাতালটির সিঙ্গেল কেবিনে থাকার পর শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে ছাড়পত্র নেওয়ার সময় এ বিল দিতে বলা হয় ওই অন্তঃসত্ত্বার স্বজনদের।

জান্নাতি বেগম জেলার সালথা উপজেলা সদর বাজার সংলগ্ন এলাকার রাজা শেখ নামের এক ব্যক্তির স্ত্রী। রাজা শেখ পেশায় একজন কৃষক।  

ওই নারীর দেবর আবু রায়হান শেখ বলেন, আমরা খুব গরিব মানুষ। আমার ভাই কৃষি কাজ করেন। খুব স্বল্প আয়ে আমাদের সংসার চলে। সেখানে আমাদের মতো পরিবারের ২৪ হাজার ৯৫৩ টাকার বিল দেখে হতবাক হয়ে যাই। আমরা জানি সিজারের যাবতীয় চার্জ মিলে হয়তো ১২-১৪ হাজার টাকা বিল করতে পারে। সেখানে এত টাকা কীভাবে বিল করলো বোধগম্য হচ্ছে না।  

আবু রায়হানের অভিযোগ, ফরিদপুরের বেশ কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে এমন অনিয়ম চলছে। সংক্ষিপ্ত কর্তৃপক্ষ নীরব থাকায় এরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।  

আবু রায়হান বলেন, আমি এর আগে আমার এলাকার আরও ৬ অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিজার করতে দেখেছি। সেখানে তাদের বিল করা হয়েছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। কিন্তু আমরা ফরিদপুর শহরের আলীপুরে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি না করাতে তারা এই ডাকাতির বিল করেছে। আমাদের মতো গরিব মানুষের এভাবে পকেট কাটলে আমরা যাব কোথায়? এদের বিচার চাই, যাতে আর কোনো হাসপাতাল এমনটা করতে দৃষ্টান্ত না দেখায়।

আবু রায়হান আরও বলেন, হাসপাতালটিতে ২৪ হাজার টাকার বেশি বিল করার পর স্থানীয় একজন সাংবাদিক ও একজন পুলিশ কর্মকর্তা হাসপাতালটির ব্যবস্থাপককে ফোন দিলে প্রথমে ১৭ হাজার এবং পরবর্তীতে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা বিল করেন। পরে এই টাকা ধারদেনা করে আমরা পরিশোধ করতে বাধ্য হই।

এ ব্যাপারে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ ফরিদুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই বিল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার ইরা ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. পলি বেগমের মতো ডাক্তারদের দিয়ে গর্ভবতী মায়েদের সিজার করানো হয়। এছাড়া হাসপাতালটির বিভিন্ন চার্জ মিলে আমরা এরকম ড্রাফট বিল করে থাকি। তবে, এটাই রোগীদের পরিশোধ করতে হবে এমন না। রোগীদের সন্তুষ্টির জন্য পরে এ বিল থেকে ৫০০ কিংবা এক হাজার অথবা একটু কম-বেশি করে ডিসকাউন্ট করি। যাতে রোগী ও রোগীর স্বজনরা সন্তুষ্ট হন।  

বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ১২ কিংবা ১৩ হাজার টাকায়ও প্রসূতি মায়েদের অস্ত্রোপচার করানো যায়, এই হাসপাতালে এত বেশি কেন? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদুল হুদা বলেন, দেখুন অনেক হাসপাতালেই এমন রেটে সিজার করাতে পারবেন ঠিকই। তবে, আমরা ফরিদপুরের আরোগ্য সদন হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালের অস্ত্রোপচারের চার্জের সঙ্গে অনেকটা মিল রেখে এমন বিল করে থাকি। আমাদের কিছু করার নেই! আমরা কম বিল করলে নিজ পকেট থেকে কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে এ ব্যবস্থাপক বলেন, আমরা তিন দিনের ওটি (অস্ত্রোপচার কক্ষ) চার্জ, কেবিন বিল ও ডাক্তারের ফিসহ সর্বোচ্চ ১৯ হাজার টাকা বিল করতে পারি। কিন্তু ২৪ হাজার টাকা বিল কেন করা হলো বিষয়টি দেখছি।  

এ ব্যাপারে ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি শিপ্রা গোস্বামী বাংলানিউজকে বলেন, যে কোনো হাসপাতালই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সেটা সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি। যদি এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠে তবে এতে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। আর এসব অসামঞ্জস্য ঘটনাগুলোকে স্বাস্থ্য বিভাগের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। তবেই হয়তো এসব হয়রানি থেকে রোগীরা মুক্তি পেতে পারেন।

এ ব্যাপারে ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বাংলানিউজকে বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার চেয়ে ব্যবসা প্রধান্য দিচ্ছে। এই ব্যবসার কারণে সেবার নামে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, এ রকম হাজারও অসঙ্গতির ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে রোগীদের সঙ্গে। তাই দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার পাশাপাশি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে।

পান্না বালা বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলো আরও আধুনিকায়ন করা দরকার। যাতে রোগীরা বাইরের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর দিকে না ঝুঁকে সেখানে চিকিৎসা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

এ ব্যাপারে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ছিদ্দীকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো চলে তাদের সমিতির মাধ্যমে। তাদের নির্ধারিত রেটের মাধ্যমে তারা সিজার করে থাকেন। তাই আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে ২৪ হাজার টাকা যদি বিল করে থাকে সেটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমি যেটুকু জানি ৮ থেকে ১০ কিংবা ১২ হাজার টাকায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো গর্ভবতী মায়েদের সিজার করে থাকে।

সিভিল সার্জন বলেন, ফরিদপুরে দুটি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার, ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। রোগীরা ১-২ হাজার টাকায় প্রয়োজনে সিজার করাতে পারেন। তারা কেন প্রাইভেট হাসপাতালে যাবেন? রোগীদের এ ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল শেখ বাংলানিউজকে বলেন, এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী পরিবার যদি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় তবে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো তাদের কিছু স্বতন্ত্র নিয়মে চলে। তবে কোনো রোগীর বিল সংক্রান্ত কোনো আপত্তি যদি থাকে, আর সেটা আমাদের লিখিত আকারে দিলে তদন্ত করে দেখা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।