ঢাকা, বুধবার, ১৮ চৈত্র ১৪৩১, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০৩ শাওয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

দেশে দেশে যেভাবে ঈদ উদযাপিত হয়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১২ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৫
দেশে দেশে যেভাবে ঈদ উদযাপিত হয়

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইয়েমেনসহ ১১টি মুসলিম দেশে আজ রোববার (৩০ মার্চ)  ঈদুল ফিতর উদযাপিত হচ্ছে। এছাড়া ১৪টি মুসলিম দেশে আগামীকাল সোমবার (৩১ মার্চ)  ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে।

ঈদের নামাজ আদায়ের মতো অভিন্ন সংস্কৃতি ছাড়াও প্রতিটি দেশের মানুষ নিজস্ব সংস্কৃতি মেনে ঈদ আনন্দ নেবেন।

সৌদি আরব

সৌদি আরবে ঈদের দিন ঘরে ঘরে সুগন্ধি বাখুর ধূপ জ্বালানো হয়। বাখুরের সুবাসে বাতাস ভরে ওঠে। কেউ কেউ লাউডস্পিকারে ঈদের গান বাজিয়ে থাকেন। ঈদের আগের রাত থেকেই গান বাজানো চলতে থাকে। বাড়ির ভেতরে-বাইতে লণ্ঠন এবং আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো হয়। সৌদি নাগরিকরা তাদের প্রিয় সুগন্ধি মেখে আনন্দে শামিল হন।

ঈদকে ঘিরে প্রতিটি সৌদি পরিবারের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য থাকে। কিছু বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি পনিরের প্ল্যাটার এবং রুটি পরিবেশন করা হয়। কিন্তু একটি কাজ সবাই করেন। তা হলো নতুন পোশাক পরে পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেতে বসে একসঙ্গে রুটি ভাগ করে নেন। এটি আরবদের অনেক পুরোনো ঐতিহ্য। এছাড়া, প্লেটভর্তি চকোলেট, খেজুরে ঠাসা মামুল পেস্ট্রি এবং অতিথিদের উপহার দেওয়ার জন্য মিষ্টি ছাড়া আরবদের ঈদ জমেই না। বাড়ির শিশুরা ঈদি (সালামি) আর উপহারের অপেক্ষায় থাকে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত

সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ঈদি বা ঈদিয়া প্রদান ঈদ উদযাপনের বড় অংশজুড়ে রয়েছে। আনন্দ ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বাড়ির এবং প্রিয়জনদের শিশুদের অর্থ উপহার দেওয়া হয়। এই প্রথা আশীর্বাদের প্রতীক। প্রায়ই ঈদির সঙ্গে ছোট ছোট উপহারও দেওয়া হয়।

ঈদে ঘর সাজানোর রেওয়াজ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও আছে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব একত্রিত হয়ে পানাহার করেন। দেশটিতে ঈদে তৈরি করা জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে ‘আউজি’। এটি ধীরে রান্না করা ভাত এবং মাংসের একটি পদ। সাথে থাকে লুকাইমাত মিষ্টি এবং খেজুরের জুসে ভেজানো ডুবো তেলে ভাজা ডাম্পলিং।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের নারীরা ঈদ উপলক্ষে জটিল মেহেদির নকশায় তাদের হাত সাজায়। এর জন্য ঈদের আগের দিনগুলোতে বিউটি সেলুনগুলোতে উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। শপিংমল এবং রাস্তাসহ পাবলিক প্লেসগুলো উৎসবের আলো, লণ্ঠন এবং চাঁদ-তারার নকশায় সাজানো হয়। অভাবী আর সুবিধাবঞ্চিতরাও যেন ঈদের আনন্দে যোগ দিতে পারে, তা নিশ্চিত করে অনেকে অর্থ দান করে থাকেন।

ইয়েমেন

ইয়েমেনে বাড়ির ছাদে আগুন জ্বেলে ঈদুল ফিতরকে স্বাগত জানানো হয়। তাই বাড়ির ছোট সদস্যরা লাকড়ি সংগ্রহে ঈদের আগেই লেগে পড়ে। ঈদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছেলেরা আগুন আর আতশবাজি জ্বালিয়ে ঈদ উদযাপন শুরু করে দেয়। সেখানকার নারীরাও মেহেদি দিয়ে হাত রাঙায়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঈদের শুভেচ্ছা আদান-প্রদান করে। এভাবে তারা কেক, মিষ্টি আর ঈদি সংগ্রহ করে। ঈদির অর্থ আরও মিষ্টান্ন আর খেলনা কিনতে ব্যয় হয়।  

বিয়ে অথবা বাগদানের জন্য অনেক ইয়েমেনি ঈদের দিনটি বেছে নেন। বিবাহিত দম্পতিরা এই ধরনের উপলক্ষগুলোকে দ্বিগুণ আনন্দ হিসেবে মনে রাখে। দিনটিতে বাড়ির বড়রা ছোটদের কপালে চুমু খেয়ে দোয়া করে দেন। তারা গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করেও ঈদের আনন্দ নেন।  

ইরান

ইরানে ঈদ উৎসবে রাস্তার ধারে বড় বড় ব্যানার সাঁটানো হয়। সরকারিভাবে মিষ্টির ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় রাস্তাজুড়ে ফিতরা ও কাফফারার বাক্সের দেখা মেলে। দেশটিতে ঈদুল ফিতরের প্রাতঃরাশ হল মিষ্টি খাবার, যার মধ্যে রয়েছে বোয়েবার। এটি খেজুর দিয়ে ভার্মিসেলি রান্না করে তৈরি একটি খাবার। দুধে আলাদাভাবে রান্না করা ভার্মিসেলি এবং খেজুরও ঈদের নামাজের আগে নাস্তা হিসেবে খাওয়া হয়।  

ইন্দোনেশিয়া

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতে ঈদুল ফিতর আয়োজিত হয় খুবই আড়ম্বরের সঙ্গে। ‘লাপিস লেজিট’ নামে বহুস্তরের কেক বানানো থেকে ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরির মধ্যে দিয়ে তাদের উৎসবমুখরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঈদ আয়োজনকে ‘লেবারান’ বলা হয়। এতে ঢোল বাজানো হয়, তারাবাতি আর ফানুসের আলোয় ভরে ওঠে পুরো ইন্দোনেশিয়ার আকাশ। এ যেন ঈদের খুশি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার এক অসামান্য দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া আছে ‘হালাল-বিহালাল’ নামের রীতি। এর মাধ্যমে অতীতের সব কাজের জন্য আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন থেকে ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের পবিত্র করা হয়।  

নাইজেরিয়া

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার প্রায় ২২ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেকই মুসলিম। অধিকাংশ নাইজেরিয়ান মুসলমান থাকেন দেশটির উত্তর প্রান্তে, সেখানে রোজার ঈদের স্থানীয় নাম আস সাল্লাহ, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। সেখানে আড়ম্বরপূর্ণ ঈদ উদযাপন হয়। নতুন পোশাক পরে প্রতিটি পরিবারের নারী-পুরুষ ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে ঈদের সকালে নামাজে যায়, যা স্থানীয় ভাষায় ‘দুরবার’ নামে পরিচিত। ঈদে সেখানে সুয়া (শিক কাবাবের মতো খাবার), জল্লফ রাইস (টমেটো, মশলা এবং নানা সবজি দিয়ে রান্না করা ভাত) এবং মইন মইন (সেদ্ধ মটরের পুডিং) খুব জনপ্রিয়।

উজবেকিস্তান 

মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে ঈদুল ফিতর বেশ ঘটা করেই উদযাপন করে। স্থানীয়দের কাছে দিনটি পরিচিত ‘রুজা হায়িত’ নামে। স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশটিতে তিন দিনব্যাপী ছুটি নিয়ে ঈদ উদযাপন করা হয়। ঈদের আগের দিনটিকে তারা বলে আরাফা। আর এই দিনে প্রায় প্রতিটি উজবেক পরিবারে ঐতিহ্যবাহী প্যাস্ট্রি কুশ টিল, বুগিরসক; অভিজাত প্যাস্ট্রি ওরামা, চাক-চাক ইত্যাদি তৈরি করা হয়। আর রাতে ঘরে ঘরে উজবেক প্লভ রান্না হয়। এটি বিরিয়ানির মতো খাবার। একে অপরের বাড়িতে এই প্লভ পাঠায় তারা।  

মরক্কো 

মরক্কোর প্রায় ৯৯ শতাংশ অধিবাসীই মুসলিম। যে কারণ দুই ঈদ দেশটির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ঈদের নামাজকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘মুসাল-লা’। নামাজের পর পরিবারের সবাই একত্র হয়ে নানা রকম মিষ্টি আর স্ন্যাকস খায়। আর এসব স্ন্যাকসের প্রায় সবই অপরিহার্য উপাদান হলো আলমন্ড। কাব ঘাজাল (আলমন্ডের পুর দিয়ে তৈরি একরকম পুলিপিঠা), মাহাঞ্চা (আলমন্ড স্নেক প্যাস্ট্রি), ঘ্রিবা (চকলেটি আলমন্ড কুকি) এমনই কয়েকটি খাবার। দিনের প্রথমভাগে স্বামীর বাবার বাড়িতে আর তারপর স্ত্রীর বাবার বাড়িতে বেড়াতে যায়। এরইমধ্যে ছোটদের দেওয়া হয় ঈদের সালামি বা ঈদি।

রাশিয়া

রাশিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠী মূল জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম। দেশটির বেশ কয়েকটি প্রদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এসব প্রদেশে ঈদের দিনটি ছুটি থাকে। তবে চেচনিয়া ও দাগেস্তান প্রদেশ দুই ঈদের ছুটি তিন দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। চেচনিয়ায় ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই বাড়িঘর পরিস্কার করে ঝকঝকে-তকতকে করে ফেলা হয়। গৃহিণীরা মিষ্টান্ন আর স্ন্যাকস তৈরি করেন। নতুন পোশাকে ঈদের নামাজ শেষে মৃত আত্মীয়দের কবর জিয়ারত করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রাশিয়ান মুসলিমদের কাছে।  

রাশিয়ার মস্কোয় একটি ঈদের জামাত

কেনিয়া

পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও দেশটির ৫০ লাখেরও বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী খুব উদ্দীপনা নিয়ে ঈদ পালন করে। ঐতিহ্যগতভাবে কেনিয়ার মুসলমানরা ঈদের আগে বাড়ি নতুন করে রং করে। ঈদের দিনে কেনিয়ানদের কাছে খুব পছন্দের একটি খাবার হলো এমকাতে ওয়া মায়াই (আফ্রিকান স্পঞ্জ কেক)। ঈদের নামাজের পর বাচ্চারা নতুন জামাকাপড় পরে বেরিয়ে পড়ে ঈদের জন্য। তারা সারা দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকে, আর প্রতিটি বাড়ি থেকেই হয় টাকা নয়তো কোনো মিষ্টান্ন দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২৫
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।