ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

নাটকীয় মার্কিন নির্বাচন ২০২০

শাওন সোলায়মান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২০
নাটকীয় মার্কিন নির্বাচন ২০২০

ঢাকা: ২০২০ সালটা যেমন ছিল কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের তেমনি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে থাকা নাটকীয়তারও। বছরের শেষভাগে এসে নজীরবিহীন এক নির্বাচনের সাক্ষী হয়েছে গোটা পৃথিবী।

দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘটনা প্রবাহ নিয়েই এবছরের নির্বাচনী সালতামামি থাকছে এখানে।

 

জানুয়ারি

নভেম্বর নির্বাচন নিয়ে যখন পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী হাওয়া বইছে, রাজ্যগুলোতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বাছাই করতে যখন চলছে নির্বাচন পূর্ববর্তী নির্বাচন, তখন সেখানে হানা দেয় কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস। ২১ জানুয়ারি রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোভিড আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। ৩০ জানুয়ারি করোনার জন্য বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এমন পরিস্থিতিতে বেশ বাঁধা পড়ে নির্বাচনী ডামাডোলে।


ফেব্রুয়ারি

ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ ট্রাম্পকে দাঁড়াতে হয় হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভস-এ। স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন এড্রেস বলে পরিচিত এই ভাষণে ট্রাম্প তৃতীয়বারের মতো বক্তব্য উপস্থাপন করছিলেন। তবে দিনটি ট্রাম্প আরও একটি কারণে মনে রাখবেন। ১৯৯৯ সালে বিল ক্লিনটনের পর হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভস-এ অভিশংসন হওয়া দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের বক্তব্যের মাঝেই হাউজের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি নিজ বক্তব্যের লিখিত কাগজ ছিড়ে হাউজ থেকে বের হয়ে যান।

তবে পরের দিনই দুই তৃতীয়াংশ ভোটের অভাবে সিনেটের অভিশংসন থেকে বেঁচে যান ট্রাম্প। সুযোগ পান পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার।

মার্চ

মার্চের ১১ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে বিশ্ব মহামারির ঘোষণা দেয়। এরপরের দিন জাতীয় ডেমোক্রেটিক কমিটি ১৫ মার্চ তাদের ১১ তম বিতর্ক অ্যারিজোনা থেকে ওয়াশিংটন ডিসি’তে সিএনএন অনুষ্ঠানে স্থানান্তরিত করে। ১৩ মার্চ দেশজুড়ে করোনা ইস্যুতে জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই দিন লুসিয়ানা দেশটির প্রথম অঙ্গরাজ্য হিসেবে নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রার্থী বাছাই এর নির্বাচন বাতিল করে।

 

এপ্রিল

৮ এপ্রিল দিনটা ছিল জো বাইডেনের। ডেমোক্রেট দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার একদম কাছে চলে আসেন বাইডেন। এদিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্স দলের মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসলেও জো বাইডেনই যে ডেমোক্রেটদের হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে যাচ্ছেন সেটা একরকম নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৩ এপ্রিল এক টেলিভিশন লাইভে এসে জো বাইডেনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান স্যান্ডার্স।

 

মে

মে মাসের ২২ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে লিবারেটিয়ান দল অনলাইনে তাদের জাতীয় সম্মেলন সম্পন্ন করে। এই সম্মেলন থেকে জো জার্গেনসকে প্রেসিডেন্ট পদে এবং স্পাইক কোহেনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলটি মনোনয়ন দেয়।

 

জুন

১৫ জুন লুইস ডিজয় যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। করোনা পরিস্থিতিতে এবারের নির্বাচনে ব্যালট ভোট যে বেশি জমা পড়বে সে বিষয়টি আগে থেকেই অনুমেয় ছিল। আর তাই ডাক বিভাগের প্রধান হিসেবে কে আসছেন সেই দিকে নজর ছিল সবার।

২০ জানুয়ারি ওকলাহোমা’তে একটি গণজমায়েতের আয়োজন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনা পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের এমন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানকে ঘিরে মার্কিনীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ছিল বলে দাবি করেছিলেন ট্রাম্প। ট্রাম্প জানিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে অন্তত এক মিলিয়ন মানুষ আবেদন করেছেন। তবে ১৯ হাজার মানুষ ধারণক্ষমতার ঐ অনুষ্ঠানে ছয় থেকে ১২ হাজার ট্রাম্প সমর্থক এসেছিলেন। পরে জানা যায়, ট্রাম্পকে ‘ট্রল’ করতেই কিছু টিকটকার অনেকগুলো টিকিটের আবেদন করেছিলেন।

 

জুলাই

৯ থেকে ১২ জুলাই গ্রিন পার্টি অনলাইনে তাদের জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করে এবং হওই হকিন্সকে প্রেসিডেন্ট পদে ও অ্যাঞ্জেলা ওয়াকারকে ভাইস প্রেসিডন্ট পদে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন।

 

আগস্ট

১১ আগস্ট কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন। আগস্টের ১৮ তারিখ ডেমোক্রেট দল জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট এবং কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। বার্নি স্যান্ডার্সের এক হাজার ১৫১ ডেলিগেটস ভোটের বিপরীতে জো বাইডেন তিন হাজার ৫৫৮ ডেলিগেট ভোট অর্জন করেন।

 

সেপ্টেম্বর

ট্রাম্প শিবিরের কফিনে পেরেজ ঢোকার কাজটা হয়তো শুরু হয়েছিল ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে। এদিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট জাজ স্ট্যানলি অ্যালেন বাস্টিয়ান দেশব্যাপী এক আদেশে ট্রাম্প সমর্থিত ডাক বিভাগের প্রধান ডেজয় এর পূর্ববর্তী এক আদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর ফলে ডাক যোগে ৩ নভেম্বরের পরে আসা ভোটগুলোও গণনার শামিল করা হয়। একই দিন পেনসিলভানিয়ার সর্বোচ্চ আদালত ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ডাক যোগে আসা ভোট গণনা করা হবে বলে রায় দেয়। এর ফলে ৩ নভেম্বর ভোটগ্রহণের আরও তিন দিন পরেও যেসব ভোট ডাক যোগে পৌঁছাবে সেগুলো বৈধতা পায়।

এই মাসেরই ২৩ তারিখ এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান দেন যে, নির্বাচনে হেরে গেলে খুব সহজে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না তিনি।

 

অক্টোবর

অক্টোবরের ১ ও ২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প কোভিড আক্রান্ত হিসেবে পজিটিভ হন। তবে ২ তারিখ জো বাইডেন এর করোনা নেগেটিভ ফলাফল আসে। এরপর ক্যালেন্ডারে তারিখ যত আগাতে থাকে নির্বাচনের উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকে। ২২ অক্টোবর প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট কমিশনের উদ্যোগে চতুর্থ প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক আয়োজিত হয়।

 

নভেম্বর

৩ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ৪ নভেম্বর থেকেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে আংশিক ফলাফল আসতে থাকে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষোভ। হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন এবং একের পর এক টুইটে ভোটে কারচুপির অভিযোগ জানাতে শুরু করেন ট্রাম্প।

৭ নভেম্বর এপি, ফক্স নিউজ এবং আরও বেশ কয়েকটি শীর্ষ গণমাধ্যমে পেনসিলভানিয়াতে জো বাইডেনকে জয়ী ঘোষণা করেন। এর মধ্যে দিয়ে প্রয়োজনীয় ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট অর্জনের মাইল ফলক স্পর্শ করেন বাইডেন। বেসরকারিভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তিনি। দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পাওয়া বাইডেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে মামলা দায়ের করতে শুরু করেন ট্রাম্প।

১৭ ও ১৮ নভেম্বর উইসকনসিনের দুইটি কাউণ্টিতে পুনরায় ভোট গণনার দাবিতে ৩ মিলিয়ন ডলার ফি দেন ট্রাম্প। নভেম্বরের ২৫ তারিখ কারচুপির অভিযোগ এনে মিশিগান এবং জর্জিয়ায় পুনঃভোট গণনার জন্য আদালতে মামলা করেন। ২৬ নভেম্বর ধন্যবাদ জ্ঞাপনমূলক ভাষণে জো বাইডেন এর কাছে প্রেসিডেন্ট পদে ছেড়ে দেওয়ার কথা প্রথমবারের মতো বলেন ট্রাম্প। তবে শর্ত জুড়ে দেন যে, আদালত যদি তাদেরকে (বাইডেন-হ্যারিস) বৈধ বলে রায় দেন তবেই তিনি এমনটা করবেন। আর আদালত যদি এমনটা করে থাকে তাহলে সেটি ভুল হবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন ট্রাম্প।

 

ডিসেম্বর

ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে দায়ের করা ট্রাম্পের বেশিরভাগ মামলার রায় আসতে শুরু করে। এগুলোতে ভোট পুনরায় গণনা করার ট্রাম্পের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। তবুও ১৩ ডিসেম্বর ফক্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘নির্বাচন শেষ হয়ে যায়নি’ বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

১৪ ডিসেম্বর বিভিন্ন রাজ্যের ইলেকটোরালরা স্ব স্ব রাজ্যে প্রধান শহরে নিজ নিজ প্রার্থীদের স্বপক্ষে ভোট দেন। এতে জো বাইডেন মোট ৩০৬ এবং ট্রাম্প ২৩২টি ইলেকটোরাল ভোট পান।

ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের নাটকীয়তা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। সব শেষ করে আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউজে পা রাখতে পারেন কি না সেটিই হবে দেখার বিষয়। আর এমনটা হলে তার সঙ্গী হবেন দেশটির প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২০
এসএইচএস/এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।