ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মুক্তিযুদ্ধের গল্প (২য় কিস্তি)

নীলু আর বিলু | এহসান হায়দার

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৫
নীলু আর বিলু | এহসান হায়দার

(পূর্ব প্রকাশের পর)

....নীলু আসার সময় ফ্রিজ থেকে দুটো আপেল, কলা আর পাউরুটি নিয়ে এসেছিল। কেবল পানি আনা হয়নি।

কি যে করবে বুঝতে পারছে না। এখনও ঘণ্টাখানেক হাঁটতে হবে। ওদিকে বিকাল হয়ে আসছে প্রায়। সন্ধ্যের আগেই পৌঁছানো দরকার।

‘আর একটু হাঁটবি ভাই? একটু কষ্ট কর। ’ নীলু বিলুকে বলে।

বিলু বলে, ‘আমি আর পারছি না আপু। আমার পা ভেঙে আসছে। ’

নীলু বলল, ‘ওই তো একটু দূরেই ঘিওর বাজার। তারপর তো মামাদের গ্রাম। বাজারে গেলে হয়তো পানি পাব। তারপর খেয়ে নিয়ে হাঁটবো রে, একটু কষ্টে করে চল সোনা ভাই আমার। ’

অনেক কষ্টে এগোতে থাকে নীলু আর বিলু, পেছনে মানুষের ঢল। বাজারে পৌঁছে দেখে তেমন লোকজন নেই। কিছু লোক বসে আছে। বিড়ি ফুঁকছে। একজনের হাতে বন্দুক। সে পাঞ্জাবি পরা। আর দু’জনের হাতে লাঠি, কোমরে পাঞ্জাবির উপরে বেল্ট, মাথায় জিন্নাহ টুপি। মিলু তাদের মধ্যে বয়স্ক একজনকে বলল, ‘চাচা পানি পাওয়া যাবে?’

লোকটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নীলুর দিকে। তারপর বললো, ‘ঢাকা থেকে আসতেছো? বসো, পানি খাও। তা কোন বাড়ি যাবা?’

নীলু বলল, ‘বয়াতি বাড়ি, সৈয়দ নাজিম বয়াতি আমার নানা। ’ 

সঙ্গে সঙ্গে লোকটার চোখ দুটো জ্বলে উঠল ইটের ভাটার মতো।   বললো, ‘ওরা তো নাস্তিক। পাকিস্তানবিরোধী লোক। তা এটা কে?’

বিলুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। লোকটা তার দিকে চাইতেই আর বাকি ছেলেদের দৃষ্টিতেই নীলু বুঝলো এরা রাজাকার।

নীলু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ও আমার ছোট ভাই। ’

‘তা তোমার মা-বাবা কই?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা।

নীলু বলল, ‘ওনাদের মেরে ফেলেছে গতরাতে। ’

লোকটি বলল, ‘শুনছিলাম, অধ্যাপক মানুষ তোমার বাবা। কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ওনারা মরেই ভালো করেছেন। পাকিস্তান ভালোভাবে টিকে থাকবে। তা তোমরা আর কী করবা? তুমি চলো ক্যাম্পে। খান সাহেবরা কাল আসবে। তাদের বেশ পছন্দ হবে তোমার কচি চেহারা, সুন্দরীও আছ। ’ 

নীলু কথাটি শুনে ভড়কে গেল।

লোকটা দাঁত বের করে ভয়ঙ্কর হাসি হাসতে লাগল। নীলু বলল, ‘আমরা তো নানার বাড়ি যাব। ’

লোকটা বলল, ‘তা আমরা কী তোমার পর? একদিন ক্যাপ্টেন সাহেবের সেবা করবা, পরদিন চলে যাবা। তুমি বরং তোমার ভাইকে ছেড়ে দাও। না হলে তাকে আমরা মেরে ফেলব। ’ 

নীলু কোনো কথা বলতে পারলো না। বিলু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে নীলুর দিকে।

লোকটি বিলুকে বলল, ‘তুমি বাছা ছোট মানুষ। তুমি নানাবাড়ি যাও। তোমার আপু পরশু আসবে। সামনের ওই গ্রামটা পার হলেই তোমার নানাবাড়ি। ’
 
বিলু লোকটার পায় ধরে বলল, ‘আমার আপুকে ছেড়ে দাও, যেতে দাও। ’

কিন্তু কোনো কাজ হলো না। নীলুকে ওরা টানতে টানতে নিয়ে গেল বাজারের পাশের একটা বাড়িতে আর বিলুকে বলল, ‘কাউকে কিছুই বলবি নে। তাহলে তোর বোনকে মেরে ফেলব। ’

বিলু নানাবাড়ির রাস্তাটা চেনে। এক দৌড়ে নানাবাড়ির পথে চলে এলো সে। কোথা থেকে যেন সমস্ত শক্তি বিলুর অসাড় দেহে জমা হলো। নানা, নানু ছোট মামা- সবাইকে  চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকলো বিলু।

বিলুর ডাকের যেন অপেক্ষার ছিল এই বাড়ির সবাই। তুহিন বিলুর ছোট মামা। সে শহরে থাকত। বাম রাজনৈতিক সাথে জড়িত ছিল। সপ্তাহ চারেক আগে থেকেই দলের কমান্ড পেয়ে গ্রামে এসে ছেলেদের সংঘবদ্ধ করছিল। এ খবরেই রাজাকাররা ক্ষেপেছিল। আজ সেই প্রতিশোধ নিল। তুহিন ছিল পুকুররঘাটে, দলের যুবকদের সাথে কথা বলছিল, আজ রাতে ঢাকায় যাবে বোনদের আনতে। কিন্তু তার আগেই বিলু এসে জানাল নীলুকে রাজাকারদের আটকে রাখার কথা।

খবরটা শুনে তুহিনের মাথায় আগুন ধরে গেল। রাজাকারদের এত বড় সাহস! সে তার সঙ্গীদের বলল, ‘চল, আজ রাতেই ওদের ওখানে অপারেশন করব।   কাল পাকবাহিনী আসার আগেই দালালগুলোকে শেষ করি। তারপর দেখবো ওদের কী ব্যবস্থা করি। ’

(চলবে...)

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১৫

** নীলু আর বিলু ‍|এহসান হায়দার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।