ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

সেরালি-২

ভূতপাহাড়ের ভূত-দেবতা | বিএম বরকতউল্লাহ্

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৭
ভূতপাহাড়ের ভূত-দেবতা | বিএম বরকতউল্লাহ্ ভূতপাহাড়ের ভূত-দেবতা

ফকিরবাবা ঝোলা থেকে কি একটা বের করে সেরালির হাতে দিলেন এবং তার মাথায় হাত রেখে বললেন, বেটা, মনোযোগ দিয়ে শোন- ‘ভুষাং নদীর ওপারে ভূতপাহাড়ের চূড়ায় একটা বিরাট বটগাছ আছে। সেখানে থাকেন এক মহান-দেবতা। তুই সেই পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠবি।

যাওয়ার সময় কারও সাথে কোনো কথা বলতে পারবি না, এমনকি পেছনে ফিরে তাকাতে পারবি না। আমি যা দিলাম পাহাড়ে উঠে গিয়ে তাতে তিনটা চুমা দিয়ে দুই চোখ ও কপাল ছোঁয়াবি।

তারপর আদব-লেহাজের সাথে সেই মহান দেবতার কাছে সন্তান কামনা করবি। ভাগ্য ভালো হলে দেবতা সাড়া দেবেন নইলে ফেরত আসতে হবে তোকে। ’ 

না, না, না। সেরালি হঠাৎ ফকিরবাবার পা ঝাপটে ধরে আবদার করে বললো, আমি সন্তান ছাড়া সেখান থেকে আর ফেরত আসব না বাবা, হয় আমাকে সন্তান দেবে নয়তো আমি পাহাড় থেকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে পড়ে জীবন শেষ করে দেবো। কেউ আমার লাশ খুঁজে পাবে না। আপনি দয়া করে ওই দেবতাকে একটু বলে দিন বাবা। সন্তান আমাকে দিতেই হবে।

ঠিক আছে। তুই এখন আমার সামনে থেকে দূর হ।  
সেরালি বিনয়, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত হাসি ফুটিয়ে ফকিরবাবাকে সেলাম-তোয়াজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো।  

সেরালি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। সে যাওয়ার পথে কারও কোনো কথার জবাব দেয়নি এবং পিছনেও ফিরে তাকায়নি। মাঠ, নদী, বন ও ভুষাং নদী পাড়ি দিয়ে বহু কষ্টে ভূতপাহাড়ে গিয়ে উঠলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন মলিন জোছনা রাত। সেরালি ক্লান্ত শরীরে একটু জিরিয়ে নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা এক নজর দেখে নিলো। তার ভয় ভয় করছে। পাহাড়চূড়ায় ছোট-বড় গাছ ও লতাপাতার কুণ্ডলি। দেখলো পাহাড়ের ঠিক মাঝখানের সেই বটগাছটি; যার কথা তাকে ফকিরবাবা বলেছিলেন। পেয়েছি! পেয়েছি! বলে সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো।  

সেরালি খুশি মনে গিয়ে বসে পড়লো বিশাল বটগাছটার নিচে। সে সন্তান প্রার্থনার আগে মেলা প্রস্তুতি নিয়ে নিলো। নড়ে চড়ে ভালো করে বসলো, যাতে তার কণ্ঠটা বিট্রে না করে সেজন্য সে গলা খাকরিয়ে পরিষ্কার করে নিলো। চোখের জল আর মুখের মায়া এক হয়ে যাতে মায়ালাগা ভাবের সৃষ্টি হয় সে জন্য সে কান্নার আগেই মুখটা কান্নার মতো করলো। তারপর দু’হাত উপরে তুলে মুখের কান্না, চোখের জল আর মনের আকুতি ঢেলে সে দেবতার কাছে সন্তান প্রার্থনা করতে লাগলো। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে সেরালির করুণ প্রার্থনা শুনে পাহাড়চূড়ার গাছপালারাও যেন চোখের জল আটকে রাখতে পারছে না।

ওগো দেবতা, মহান দেবতা! প্রভু আমাকে অনেক ধন-স¤পদ দিয়েছেন কিন্তু সন্তান দেননি। তিনি যার সম্পদ নেই তাকে ঘরভর্তি সন্তান দিয়ে রেখেছেন। আর যার ঘরে-বাইরে অজস্র সম্পদ তাকে কোনো সন্তানই দিলেন না। এ কেমন আচরণ, বলুন! সন্তান ছাড়া আমরা কার মাঝে কীভাবে কতদিন বেঁচে থাকতে পারি! যার সন্তান নেই, এ সমাজ-সংসারে তার না আছে মূল্য, না আছে মর্যাদা!

আমার সম্পদ রক্ষা করার জন্য আমাদের ঘরে কি একটি সন্তানেরও প্রয়োজন নেই? খোদার ঘরে কি এতোই অভাব পড়েছে সন্তানের? তিনি একটা সন্তান দিলেন না আমাকে? আর এ জন্য আমার ও আমার বউয়ের দুঃখের সীমা নেই। আমরা বৃদ্ধ হয়ে গেলে কে আমাদের দেখাশোনা করবে, কে রক্ষা করবে আমার এত কষ্টে অর্জন করা ধন-স¤পদ? দুষ্টলোকেরা আমার সম্পদগুলো চেটে-চুটে খেয়ে শেষ করে ফেলবে। তুমি আমাদের ঘরে অন্তত একটা সন্তান দাও, সেটা ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বোবা-কালা, লুলা-লেংড়া, ভালো-মন্দ, আগল-পাগল, ভূত-পেতনি যা-ই হোক, একটা দাও। আমরা সন্তানের মুখে বাবা-মা ডাক শুনে ধন্য হই!

‘কীসের জন্য তোর এতো আহাজারি আর এতো কান্না? তুই কী চাস? আমাকে প্রাণ খুলে বল তো সেরালি। ’ গম্ভীর স্বরে ভেসে এলো কথাগুলি!

সেরালি লাফিয়ে উঠলো! সে কতক্ষণ অবুঝের মতো উপরের দিকে তাকিয়ে রইল। সেরালি হাপুস-হুপুস ঢোক গিলে, চোখ মুছে, মুখটা বাড়িয়ে কাঁপা স্বরে বলল, কে! কে আপনি! আপনি কি দেবতা? আমার প্রার্থনা শুনছেন? বলুন, আপনি কি সেই ভূতদেবতা? বলুন, বলুন।

দেবতা ছাড়া পাহাড়চূড়ায় এতো রাতে তোর প্রার্থনা শোনার মতো আর কেউ আছে রে সেরালি? 

সেরালি খুশিতে মনে মনে বলে, এ যদি দেবতাই না হবে তবে আমার নাম যে সেরালি তা জানলো কী করে? যাক, পেয়ে গেছি আমার দয়ালু দেবতাকে। দেবতা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। ফকিরবাবাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে সঠিক জায়গায় দয়ালু দেবতার কাছে পাঠানোর জন্যে।  

গাছে বসে আছে এক দুষ্টভূত। সে সেরালির মুখে তার বিপুল অর্থ-সম্পদের কথা শুনে আর সন্তান লাভের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের কথা জেনে চট করে একটা দুষ্টবুদ্ধি এঁটে ফেললো। দুষ্টভূত বুঝতে পেরেছে, লাভ দেখলে কৃপণের আঙুলও ফাঁক হয়। সে দেবতারূপে নিজেকে প্রকাশ করলো।  

ভূত-দেবতা সেরালিকে আস্বস্ত করে বললো- সেরালি, তোর প্রার্থনা এতোই করুণ, এতোই কষ্টের আর এতোই হৃদয়বিদারক যে তা শুনে কারও স্থির থাকার হিম্মত নেই। আমিও পারলাম না তোর ডাকে সাড়া না দিয়ে চুপ করে বসে থাকতে। তুই যখন আমার কাছে এসেই পড়েছিস তো আর কোনো চিন্তা করিসনে। দেখি, তোর জন্য কী করা যায়।

সেরালি আনন্দে গদগদ হয়ে বলে, দেবতা, আপনার অসাধ্য কিছুই নেই। আপনি যখন আমার প্রতি সহায় হয়েছেন, তখন আমি আপনার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। আমি আপনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। সেরালি আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে আরও বললো, আপনি আরেকটু সহায় হয়ে যদি আমাকে একটু দেখা দিতেন, চোখ-মন দুইই সার্থক হতো!  

বিশ্বাসের জোর কম বলেই তুই দেবতাকে দেখতে চাস। কোনো খাঁটি বান্দা-বান্দি দেবতাকে সরাসরি দেখার আগ্রহ করে না; সবাই আরাধনা করে তার করুণা পেতে চায়। ভারী গলায় বললেন দেবতা।

সেরালি লজ্জায় পড়ে গেলো। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললো, না, না, না অবিশ্বাসের কারণে নয় বাবা, আপনার ওপর আমার ষোলোআনার ওপর আঠারো আনা বিশ্বাস আছে। আসলে আমি ভুলেই গেছি যে, দেবতাকে দেখা যায় না। দেবতা তো দেখার জিনিস না- উপাসনা করে সন্তুষ্ট করার জিনিস। আমি খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত। হে মহান দেবতা! দয়া করে আমার এ অনিচ্ছাকৃত ভুল আর বেয়াদবি মার্জনা করে দেবেন।

পরবর্তী পর্ব: ভূত-দেবতার চালাকি

বাংলাদেশ সময়: ২১০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৭
এএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।