ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শেষ বয়সে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেন হামিদা

মহিউদ্দিন মাহমুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০২৩
শেষ বয়সে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেন হামিদা ৬০ বছর বয়সে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হামিদা খাতুন | ছবি: শাকিল আহমেদ

গাজীপুর থেকে: ৬০ বছরের জীবনে প্রায় ৪০টা বছরই কখনো পলিথিনের তাবু, কখনো গাছ তলায় বা স্টেশনে, আবার কখনো অন্যের বাড়িতে ভাড়া থেকে কাটিয়েছেন হামিদা খাতুন। মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে একমাত্র সন্তানকে বুকে আগলে ঘুরেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।

অবশেষে নিজের একটা ঘর, ছোট্ট একটা জমি না থাকার সেই দুঃখ ঘুচলো হামিদা খাতুনের। আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে গাজীপুরের শ্রীপুরের নয়াপাড়ায় একটা পাকা ঘর ও এক টুকরো জমি পেয়ে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই বৃদ্ধার।

বুধবার (২২ মার্চ) চতুর্থ দফায় সারাদেশে হামিদা খাতুনের মতো প্রায় ৪০ হাজার পরিবারকে ঘর দেবে শেখ হাসিনার সরকার। এসব পরিবারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হবে হামিদা খাতুনকেও।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের বাসিন্দা হামিদা খাতুন। বিয়ের আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে নিজের বাড়িতে থাকার সুযোগ হলেও বিয়ের পর ভিটে-মাটিহীন দিনমজুর স্বামীর সঙ্গে জীবন শুরু হয় ভাড়া বাসায়। টানাপোড়েনের মধ্যেও সুখেই কাটছিল তাদের সংসার। কিন্তু সেই সুখও বেশিদিন টেকেনি।

বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দিনমজুর স্বামী। এরপর থেকে হামিদা খাতুনের কষ্টের দিন শুরু। ৩-৪ বছরের ছোট্ট ছেলেকে বুকে আগলে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে রীতিমত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তিনি।

মঙ্গলবার (২১ মার্চ) দুপুরে গাজীপুরের শ্রীপুর নয়াপাড়া আশ্রায়ণ প্রকল্পে পাওয়া নিজের নতুন ঘরে বসে কষ্টে ভরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন হামিদা খাতুন ও তার ছেলে লিটন হোসেন সুমন।

নতুন ঘর পাওয়া হামিদা খাতুন উপহারের ঘরে বসেই দুই হাত তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন। এ সময় তাকে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়।

অশ্রুসিক্ত হামিদা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, কখনো মানুষের বাড়িতে, কখনো গাছতলায়, স্টেশনে, রাস্তাঘাটে পলিথিনের মধ্যে রাত কাটাইছি। মানুষ তাড়িয়ে দিয়েছে, কাঁথা-বালিশ ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। কখনো ভাড়া থেকেছি, ভিক্ষা করে ভাড়া যোগাড় করেছি। অন্যের বাড়িতে রায়ত (কাজের বিনিময়ে বা অনুগ্রহ হিসেবে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় থাকা) ছিলাম।

হামিদা খাতুনের সন্তান লিটন হোসেন সুমন বাংলানিউজকে বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। ঘর না থাকায় জীবনে অনেক লাথি-উষ্ঠা খাইছি।

ঘর পাওয়ার আনন্দঅশ্রু চোখে নিয়ে হামিদা খাতুন বলেন, শেখ হাসিনা আমগোরে দেখছে, আমগোরে ঘর দিছে। আল্লাহ মায়াকে (মা, শেখ হাসিনা) অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুক। আরও হাজার হাজার মানুষকে ঘর দিক।

হামিদা খাতুনের ছেলে সুমন রিকশা চালক। আশ্রায়ণের ঘর পাওয়ার আগে তারা ভাড়া বাসায় ছিলেন। সুমনের বয়স যখন কম ছিল, সেই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছেন তারা।

হামিদা খাতুনের মতো এখানে আশ্রায়ণের ঘর পেয়েছেন মালেকা বেগম (৭০)। জীবনের পুরোটা সময় তিনি কখনো বাবা-মায়ের সঙ্গে, কখনো স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাসায় ছিলেন। বিয়ের ৮/১০ বছরের মাথায় স্বামী মারা গেলে সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবন একাই লড়াই করেছেন। অন্যের বাসায় কাজ করে সংগ্রাম করেছেন।

বুধবার (২২ মার্চ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হবে মালেকা বেগমকেও। তবে তার আগেই (২১ মার্চ) সব মালামাল নিয়ে নতুন বাসায় উঠেছেন তিনি।

মালেকা বেগম বলেন, সারাজীবন মানুষের বাড়িতে কষ্ট করে রইছি। আল্লাহর রহমতে আমরা বাড়ি পাইছি। শেখ হাসিনা আমগো বাড়ি দিছে। আল্লাহ তারে ভালো রাখুক।

এখানে আশ্রায়ণের ঘর পাওয়া ৬৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, গত ১৫ বছর থেকে ভাড়া বাসায় আছি। বাকি জীবন রায়ত ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি, তিনি যেন মানুষের আরও সেবা করতে পারেন।

হানিফ আরও বলেন, ঈদ উৎসব মানুষের আনন্দের। এই ঘর পাওয়া ঈদের চেয়ে বড় আনন্দের।

নয়াপাড়ায় ঈদ উৎসবের আমেজ
শ্রীপুরের নয়াপাড়া আশ্রায়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, এখনকার ঘরে ঘরে যেন ঈদের মতো আনন্দ। আগের বাসস্থান থেকে মালামাল নিয়ে নতুন ঘরে উঠছেন সবাই। কেউ বা নিজেদের ঘর সাজাচ্ছেন।

অনেকে দুই-একদিন আগে উঠে গেছেন, রান্নায় ব্যস্ত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন ঘরে, নতুন পরিবেশে খেলাধুলায় মেতে উঠেছে।

আশ্রায়ণের ঘরের পাশাপাশি এখানে নান্দনিক একটি মসজিদ ও স্কুল নির্মাণ করা হচ্ছে। এ দুটোর নির্মাণ কাজ এখনো চলমান।

মঙ্গলবার (২১ মার্চ) আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিদর্শনকালে গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরের নয়াপাড়ায় ঘর পেয়েছেন ১৪২টি পরিবার।

গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, ঘরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এসব ঘর এই মানুষগুলোর জন্য ঈদ উপহার, ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের।

রোজার আগে বুধবার (২২ মার্চ) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে চতুর্থ দফায় জমিসহ ৩৯ হাজার ৩ শত ৬৫টি ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই অনুষ্ঠান থেকে তিনি ৭টি জেলার সব উপজেলাসহ সারাদেশের ১৫৯ উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন ঘোষণা করবেন।  

ইতোপূর্বে আরও দুটি জেলার সব উপজেলাসহ মোট ৫২ উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশে এখন সর্বমোট ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা সম্পূর্ণ ভূমিহীন ও গৃহহীন।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে ২ শতক জমিসহ পাকা ঘর দিচ্ছে সরকার।

এর আগে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে জমির মালিকানাসহ ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৭টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।

১৯৯৭ সাল থেকে ২১ মার্চ ২০২৩ সাল পর্যন্ত আশ্রায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৯৭টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রায়ণ ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মাধ্যমে মোট পুনর্বাসন করা হয়েছে ৭ লাখ ৭১ হাজার ৩০১ পরিবারকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০২৩
এমইউএম/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।