ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুঘল সাম্রাজ্যের নিদর্শন বাঘার ‘দশ গম্ভুজ শাহী মসজিদ’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
মুঘল সাম্রাজ্যের নিদর্শন বাঘার ‘দশ গম্ভুজ শাহী মসজিদ’

রাজশাহী: মুঘল সাম্রাজ্যের এক অন্যতম নিদর্শন রাজশাহীর ‘বাঘা শাহী মসজিদ’। রাজশাহী শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলা সদরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক মসজিদ।

 

১৫২৩-১৫২৪ সালে (৯৩০ হিজরি) হুসেইন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের ছেলে সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরত শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলন। কালের সাক্ষী হয়ে যা আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। রাজশাহীর প্রাচীন এই স্থাপত্যকে বাংলাদেশের ইসলামী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়।

সুলতানি আমলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা হযরত শাহ মোয়াজ্জিম দানিশমন্দ ওরফে শাহদৌলার (রহ.) সম্মানে ১৫২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন- সুলতান নাসির উদ্দীন নসরত শাহ। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হলেও টেরাকোটার সৌন্দর্য আর নির্মাণ শৈলীর কারণে এখনও মসজিদটি দেশের অন্যতম প্রত্ননিদর্শন হিসেবে পর্যটকদের হৃদয় কাড়ে।  

ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, ষোলো শতকের গোড়ারদিকে পদ্মা নদী পথে বাঘায় ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন হজরত শাহ মোয়াজ্জিম দানিশ মন্দ ওরফে শাহদৌলা (রহ.)। তিনি ছিলেন বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশিদের বংশধর। এ সাধক আলা বকশ বরখুরদারের মেয়েজেবুন্নেছার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।  

জনশ্রুতি আছে, সুলতান নাসির উদ্দীন নসরত শাহ পদ্মা নদী দিয়ে ঢাকার বিদ্রোহ দমন যাচ্ছিলেন। পথে তার বাহিনীর সবাই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন।

তখন বাঘায় যাত্রা বিরতি দিয়ে নাসির উদ্দীন দেখেন, বাঘবেষ্টিত একজন সাধক ধ্যানে বসে আছেন। তখন তারা সাধক শাহ দৌলার কাছে তাদের অসুখের কথা বলেন। পরে শাহ দৌলার দেওয়া ওষুধ খেয়ে তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন।  

নাসির উদ্দীন জানতে চান, এ সময় ঢাকায় যাওয়া উচিত হবে কীনা? সাধক তাদের একদিন অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর তিনি জানান, আর ঢাকায় যেতে হবে না। যুদ্ধে তারা জয়লাভ করেছেন। একদিন পর দূত এসে জানান, সত্যিই তারা যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। সুলতান সাধকের প্রতি অভিভূতহন এবং কিছু নিষ্কণ্টক জমি নেওয়ার অনুরোধ জানান।

পার্থিব সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত সাধক শাহ দৌলা তা নেননি। পরে তার ছেলে আবদুল হামিদ দানিশ মন্দকে (রহ.) তা দেওয়া হয়। সুলতান তাকে ৪২টি মৌজার ভূমি দান করেন। ১৫২৩-১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসির উদ্দীন নসরত শাহ হযরত শাহ দৌলার সম্মানে বাঘায় অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত মসজিদটি নির্মাণ করেন। দেশের পুরনো ৫০টাকার নোটে ও ১০টাকার ডাক টিকিটে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ স্থান পেয়েছে।  

রাজশাহী শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মানদীর তীরে প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই দর্শনীয় শাহী মসজিদ। এখানে সুবিশাল দীঘি ও অন্য আউলিয়াদের সমাধি স্থানও মূল দরগাহ রয়েছে। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৮-১০ ফুট উঁচু একটি বেদির ওপরে এ মসজিদ তৈরি করা হয়েছে।

এর দু'পাশ দিয়ে দুটি বিশাল প্রবেশপথ রয়েছে। ইসলামিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি মসজিদটির দেয়ালে রয়েছে আমগাছ, শাপলা, লতাপাতাসহ ফার্সি খোদাই শিল্পের হাজার রকমের কারুকাজ। মসজিদটিতে রয়েছে পাঁচটি দরজা ও ১০টি গম্বুজ, ভেতরে ছয়টি স্তম্ভ ও চারটি অপূর্ব কারুকাজ খচিত মেহেরাব। ৭৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪২ ফুট প্রস্থ মসজিদের উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাঝখানের দরজার ওপরে ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। এর পূর্বদিকে রয়েছে ৫২ বিঘা আয়তনের বিশাল দীঘি।

প্রতি বছর শীতকালে এতে থাকে অতিথিপাখির কলরব। দীঘিতে পদ্ম ফুলের সৌন্দর্যও মানুষের নজর কাড়ে। সুদূর বাগদাদ থেকে পাঁচজন সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য বাঘায় এসেছিলেন শাহ দৌলা। সেখানে কাটিয়েছেন বাকি জীবন।  

শাহী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের উত্তর গেটের বাঁ দিকে হযরত শাহ মোয়াজ্জিম ওরফে শাহ দৌলা (রহ.) ও তার পাঁচ সঙ্গীর মাজার রয়েছে। শাহী মসজিদের উত্তরে খানকা বাড়ির ভেতরে তার ছেলে হযরত শাহ আবদুল হামিদ (রহ.) মাজার রয়েছে।  

রাজশাহীর বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়াল্লি খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম রহিস জানান, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বাঘা শাহী মসজিদটির ছাদক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ১৯৭৭-৭৮ সালে তা সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালে এখানে তৈরি হয়েছে শাহ দৌলার নামে বাঘা শাহ দৌলা ডিগ্রি কলেজ।  

ঐতিহাসিক এ মসজিদ দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বাঘায় আসেন। এছাড়া এখানকার প্রাচীন ও প্রাথম নারী মসজিদ এবং মহল পুকুরের ভগ্নদশাও মানুষকে নিয়ে যায় অতীত ভাবনায়।  

মসজিদ দেখতে আসা দর্শনার্থীরা জানান- মসজিদটিতে টেরাকোটার কারুকাজ আছে। বাঘা মসজিদের ওপরে যে গম্বুজগুলো আছে, তা দেখতে অনেকটা ষাট গম্বুজ মসজিদের মতো। মসজিদের কারুকাজ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। এত সুন্দরভাবে কারুকাজ করা যে, দেখেই সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবেন এবং এতে তাদের চিন্তার জগতে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।  

রাজশাহীর বাঘা প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবদুল লতিফ মিয়া বলেন, তাদের এই শাহী মসজিদ শুধু মুসলিম সম্প্রদায়েরই নয়, এটি সারা দেশের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় পুরাকীর্তি। মসজিদে এখনও নিয়মিত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। তাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই প্রাচীন স্থাপনা ও মসজিদটি সংস্কারও সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে কাছে দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
এসএস/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।