ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বাবা ফাহিম ফিরে এসো, আর বকব না’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২৩
‘বাবা ফাহিম ফিরে এসো, আর বকব না’ ঘরছাড়া ফাহিমের বাবা আইয়ুব খান বাবুল

ঢাকা: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার নির্জন পাহাড়ি এলাকার একটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ শনিবার অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট (সিটিটিসি)।  

সিটিটিসি বলছে, তারা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য।

গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে রয়েছেন চার পুরুষ এবং ছয় নারী।

অভিযান শুরুর আগেই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান চিকিৎসক জামিল ও ঘর ছেড়ে হিজরতে যাওয়া ফাহিম খান নামে এক কিশোর।  

সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, অভিযানের আগেই জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া চিকিৎসক জামিল ছিলেন কথিত ইমাম মাহমুদের অন্যতম অনুসারী। কিশোর ফাহিম খান (১৭) ঢাকার নটরডেম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সে যশোর জেলার কোতোয়ালি উপজেলার আইনজীবী আইয়ুব খান বাবুলের ছেলে।

নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম খান স্কুল জীবন থেকেই পড়াশোনা ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মেধা ও দক্ষতার প্রমাণ দেখিয়েছে, তার রয়েছে নানা অর্জন। সে যশোর জেলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ ৫ পেয়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়। পরিবারে চার ভাই-বোনের মাঝে বড় ফাহিম। সে গাইনোকমাসিয়ায় (একটি নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যধি) আক্রান্ত।  

কিন্তু মেধাবী এই শিক্ষার্থী ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামের নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্ররোচনায় উগ্রবাদী পথ বেছে নেয়। ঘর ছাড়ে পরিবারের কাউকে কিছু না বলেই।  

ঘরছাড়া ফাহিমের পরিবারের সদস্যরা যশোর জেলা পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এরই মধ্যে সিলেটে অভিযানের পর জানা যায়, ফাহিম হিজরতের নামে পাহাড়ি অঞ্চলে উগ্রবাদী ও জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছে। অভিযানের আগে সেখান থেকে ফাহিম পালিয়ে যায়।  

ছেলেকে উগ্রবাদী পথ থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ফাহিম খানের বাবা আইয়ুব খান বাবুল। গণমাধ্যমে আকুতি জানিয়েছেন তিনি।  

রোববার (১৩ আগস্ট) দুপুরে ফাহিম খানের বাবা আইয়ুব খান বাবুলের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গত ২৮ জুলাই সকালে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায় ফাহিম। এরপর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ, তাকে কোনোভাবেই পাওয়া যায়নি। এরপর আমি থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। পুলিশের কাছে দাবি জানাই, আপনারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।

তিনি বলেন, সেই থেকে আমি ছেলের খোঁজে যশোর জেলা পুলিশ ও পরে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছি। সর্বশেষ শুনেছি, আমার ছেলে ফাহিম পাহাড়ি অঞ্চলে উগ্রবাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ছিল, কিন্তু সেখান থেকেও পালিয়ে যায় সে।  

ছেলে ফাহিম সম্পর্কে আইয়ুর খান বাবুল বলেন, যশোর জেলা স্কুল থেকে জিপিএ ৫ নিয়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয় ফাহিম। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে সে হোস্টেলেই থাকত। প্রথম বর্ষে ভালো ফল করলেও পরে অসুস্থতার কারণে এক বছর গ্যাপ হয়ে গেছে। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না ফাহিম। এ কারণে সে মানসিকভাবে কিছুটা বিষণ্ন ছিল। পাশাপাশি তার পিছিয়ে যাওয়ার কারণে পরিবার থেকে একটু চাপ দেওয়ায় নিজেকে একটু আড়াল করে রাখত সবসময়।

তিনি বলেন, পারিবারিক চাপের কারণে হোক কিংবা মোবাইল ফোন বা কোনো ব্যক্তি ও সংগঠনের মাধ্যমে হোক, যেকোনোভাবে সে এই সংগঠনের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়িয়েছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে আমি আমার ছেলেকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।  

কাঁদতে কাঁদকে ফাহিমের বাবা আকুতি জানান, আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই। বাবা তুমি কোনো অসৎ পথে যেও না, পরিবারের কাছে ফিরে এসো। আমি কখনও তোমাকে বকাঝকা করব না, তুমি যেভাবে পড়াশোনা করতে চাও করো, আমি তোমার সঙ্গে সব সময় থাকব।  

তিনি বলেন, ফাহিম, বাবা তুমি কোনো অন্যায় পথে পা দিও না, তুমি যেখানেই থাকো, ফিরে এসো বাবা। সরাসরি পরিবার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হোক তুমি ফিরে এসো। তোমাকে হারিয়ে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। বাবা তুমি যা পারো তাই করে খেয়ো, আমরা আর পড়াশোনা নিয়ে চাপ দেবো না।

ফাহিমের মধ্যে কী কী পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, জানতে চাইলে আইয়ুব খান বাবুল বলেন, সে খুব বেশি নামাজ-কালাম আদায় করতো না। কিন্তু গত কোরবানি ঈদের ছুটিতে ফাহিম গ্রামের বাড়িতে আসে। এরপর দেখতে পাই তার মুখে দাঁড়ি। মাঝে মাঝে নামাজ পড়ত। অথচ আগে রোজার সময় হাফপ্যান্ট পরে আমাদের সঙ্গে ইফতারিও করেছিল। তেমনভাবে ধর্ম পালন করত না। বাড়ি ছাড়ার আগে বন্ধুদের ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এমন কিছু পরিবর্তন আসে ফাহিমের মধ্যে। এরপর একাই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যায় ফাহিম। কিন্তু যাওয়ার সময় কোনো টাকা-পয়সা নেয়নি।  

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউরা থানার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অপারেশন হিলসাইড চালিয়ে একটি জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে চারজন পুরুষ ও ছয়জন নারীসহ মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সেখানে অভিযানের সময় কয়েকজন পালিয়ে যায়।  

তিনি বলেন, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, জনৈক জামিল নামক কথিত ইমাম মাহমুদের এক অনুসারী কুলাউরা থানাধীন কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য ৫০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। দুই মাস আগে সেখানে তিনি জঙ্গিবাদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেন। তবে কত টাকা দিয়ে জমি কেনা হয়েছিল, সে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তাদের সদস্যদের জিহাদের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সবকিছুই সেখান থেকে পরিচালনা করা হতো।  

তিনি আরও বলেন, এই সংগঠনের অনেকেই আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। সংগঠনের অনুসারীসহ বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০২৩
এসজেএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।