ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রাজশাহীতে দুই চিকিৎসক খুনের কূলকিনারা পাচ্ছে না পুলিশ!

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২৩
রাজশাহীতে দুই চিকিৎসক খুনের কূলকিনারা পাচ্ছে না পুলিশ!

রাজশাহী: জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছে রাজশাহী।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একই রাতে দুই চিকিৎসক খুন হয়েছেন আততায়ীদের হাতে।

একজনকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে খুন করা হয়েছে। অপরজনকে মাইক্রোবাসে করে এসে খুন করা হয়েছে। যদিও দুই খুনের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। গত দুই দিনেও লোমহর্ষক দুই হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা বের করা যায়নি। চাঞ্চল্যকর দুই হত্যাকাণ্ডের ‘ক্লু’ উদঘাটনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

তবে হঠাৎ করে রাজশাহী শহরে খুন, ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। সন্ধ্যার পর অনেকেই বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। যেখানে রাজশাহী মহানগরের প্রধান প্রধান সড়কে রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত লোকজনের সমাগম দেখা গেছে, সেখানে এখন সন্ধ্যার পরপরই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

চলতি সপ্তাহ শুরুর পর প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে রাজশাহী মহানগরের শাহ মখদুম থানার সিটি হাট এলাকায়। পল্লি চিকিৎসক এরশাদ আলী দুলালকে (৪৮) মহানগরের চন্দ্রিমা থানা এলাকা থেকে রোববার (২৯ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর মাইক্রোবাসে করে এসে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যার পর তিনি নিজের ফার্মেসিতে ছিলেন। সেখান থেকে মাইক্রোবাসে এসে পাঁচ-ছয়জন ব্যক্তি এরশাদ আলীকে তুলে নিয়ে যায়। পরে রাত ৯টার দিকে শাহ মখদুম থানার সিটি হাট এলাকায় রাস্তার ড্রেনে পাশে তার রক্তাক্ত মরদেহ পাওয়া যায়।

পল্লি চিকিৎসক এরশাদ আলী দুলালের বাড়ি রাজশাহী মহানগরের উপকণ্ঠ কচুয়াতৈল এলাকায়। চন্দ্রিমা থানার কৃষ্টগঞ্জ বাজারে তার ওষুধের ফার্মেসি ছিল। সেখানেই তিনি পল্লি চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা দিতেন।

এরপরের খুনের ঘটনা ঘটে রোববার (২৯ অক্টোবর) দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে। মহানগরের রাজপাড়া থানার বর্ণালীর মোড়ের অদূরে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন ডা. গোলাম কাজেম আলী আহমেদ (৪২)। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) এমবিবিএস ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছিলেন ছাত্রশিবিরের রামেক শাখার সভাপতিও। যৌন ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডা. কাজেম আলীর যথেষ্ট নামডাক ছিল। তিনি রাজশাহীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতাও করতেন।

কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে নানান বিতর্ক উঠলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর শুধু রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরে থাকা পুপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চর দেবীনগরে। তবে তিনি রাজশাহী মহানগরের উপশহরে শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন। ডা. কাজেমের স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিনও একজন চিকিৎসক।

ডা. কাজেম আলীকে খুনের সময়ও মাইক্রোবাস নিয়ে আসে দুর্বৃত্তরা। রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে রাজপাড়া থানার বর্ণালী মোড় এলাকায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। দ্রুতই তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। রাত দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

ওই রাতে তিনি রাজশাহী মহানগরের লক্ষ্মীপুর এলাকায় থাকা পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার শেষ করে মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আর মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন গ্লোবাল ফার্মার মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ মো. শাহীনুজ্জামান। তিনি রাজপাড়া থানা পুলিশকে সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

শাহীনুজ্জামান পুলিশকে জানিয়েছেন, রাতে তারা যখন ফিরছিলেন তখন পেছন থেকে একটি মাইক্রোবাস এসে তাদের গতিরোধ করে। এরপর মাইক্রোবাস থেকে তিনজন ব্যক্তি নেমে এসে ডা. কাজেমের পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। ডা. কাজেম এ সময় মোটরসাইকেল থেকে নামলে তার বুকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করা হয়। এরপর দুর্বৃত্তরা ওই মাইক্রোবাস নিয়েই দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে তারা ডা. কাজেমকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার (৩০ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় মহানগরের সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে মানববন্ধন করে দেবীনগর স্টুডেন্ট কমিউনিটি, রাজশাহী নামের একটি সংগঠন। কর্মসূচি থেকে ডা. কাজেমের হত্যাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। ডা. কাজেম হত্যার প্রতিবাদে সোমবার রাজশাহীতে সব চিকিৎসকের প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বন্ধ রাখার কর্মসূচি দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) রাজশাহী শাখা। এছাড়া মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সকালে মানববন্ধন ও কালোব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করা হয়।  

রামেকে অধ্যক্ষ এবং রাজশাহী বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. অধ্যাপক নওশাদ আলী জানান, ডা. কাজেম ছাত্রশিবিরের রামেক শাখার সভাপতি ছিলেন সেই ছাত্রজীবনে। তিনি যে মতাদর্শেরই হোন না কেন, এ হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই তারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কেবল তাই নয়, মঙ্গলবারের (৩১ অক্টোবর) কর্মসূচি থেকে প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডা. কাজেম আলীর খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা না হলে তারা লাগাতার ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণা দিতে বাধ্য হবেন।

তবে চিকিৎসক নেতারা আল্টিমেটাম দিলেও ডা. কাজেম হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হক বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শাহীনুজ্জামানকে থানায় নিয়ে এসে তার কাছে ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন। তবে এখন পর্যন্ত রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।

ওসি জানান, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত চিকিৎসকের স্ত্রী ডা. ফারহানা ইয়াসমিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। তাই বর্তমানে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে।

এদিকে পল্লি চিকিৎসক এরশাদ আলী খুনেরও রহস্যও উদঘাটন করা যায়নি। পুলিশ দুজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও ঘটনার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। তাই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সোমবার দুপুরে ওই দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

পল্লী চিকিৎসক এরশাদ আলীকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হয়েছে। ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ওই ফুটেজে দেখা গেছে, চার-পাঁচজন ব্যক্তি মুখে কাপড় বেঁধে আসেন। একজনের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। ওই সন্ত্রাসীরা এরশাদ আলীকে দোকান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় দোকানে বসে থাকা দুজন ব্যক্তি ভয়ে দূরে সরে যান।

রাজশাহী মহানগরীর চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম জানান, পল্লি চিকিৎসক এরশাদ আলীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মাইক্রোবাসে করে। এরপর শাহ মখদুম থানার সিটি হাট এলাকায় নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ফার্মেসি থেকে অপহরণের পরই তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি নিজে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দোকান পরিদর্শনে যান। এর কিছুক্ষণ পরই ওই এলাকার একটি ড্রেনের পাশে অপহৃত পল্লি চিকিৎসক এরশাদ আলীর মরদেহ পড়ে থাকার খবর পাওয়া যায়।

ওসি আরও জানান, এই খুনের ঘটনা ‘ক্লু’ খুঁজছে পুলিশ। নিহতের ভাই রুহুল আমিন বাদী হয়ে চন্দ্রিমা থানায় মামলা দায়ের  করেছেন। পুলিশ তাই খুনিদের শনাক্তের কাজ করছে। একটু সময় লাগলেও আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই অপরাধীরা ধরা পড়বে এবং এই হত্যামামলার রহস্যের জট খুলবে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জামিরুল ইসলাম জানান, মহানগরে যে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। সব পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা-নীরিক্ষা করছেন। এটি শেষ না হলে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড দুটি নিয়ে ভাসা ভাসা কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন দুটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একটির সাথে অন্যটির যোগসূত্র আপাতত মিলছে না। তাই এই দুই হত্যাকাণ্ড মহানগরের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। এটা সংঘবদ্ধ কোনো অপরাধ বলে তাদের কাছে মনে হচ্ছে না। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি হয়নি। তারা এখন সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করছেন। দুই হত্যামামলার রহস্য দ্রুতই উন্মোচন হবে। অপরাধীদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তাদের একাধিক টিম বর্তমানে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন। কিছু পাওয়া গেলে অবশ্যই গণমাধ্যমকে তা জানানো হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২৩
এসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।