ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সমুদ্রের নগরে রেলের হুইসেল বাজালেন প্রধানমন্ত্রী

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২৩
সমুদ্রের নগরে রেলের হুইসেল বাজালেন প্রধানমন্ত্রী

কক্সবাজার থেকে: ১৩৩ বছরের স্বপ্ন অবশেষে হাতের মুঠোয় এসেছে কক্সবাজারবাসীর। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ট্রেনের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শনিবার (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুধী সমাবেশ শেষে বেলা ১২টা ৫৮ মিনিটে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করেন। এরপর দুপুর ১টা ২৪ মিনিটে ট্রেনের হুইসেল বাজান প্রধানমন্ত্রী।

এসময় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, স্থানীয় সংসদ সদস্য, রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা।

কক্সবাজারের সঙ্গে রেল সংযোগ করতে পেরে খুব আনন্দিত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী বক্তব্যেও শুরুতেই বলেন, আজ কক্সবাজারবাসীর জন্য একটি আনন্দের দিন, রেল যোগাযোগ স্থাপন হলো। এই কক্সবাজার এমন একটি সমুদ্র সৈকত যা বিশ্বে বিরল। বিশ্বের সব থেকে দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত, ৮০ মাইল লম্বা। পৃথিবীতে এমন দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত আর কোথাও নেই।  

বর্তমান সরকারের সময় রেলকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয় তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রসঙ্গ তিনি উল্লেখ করেন।  

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু করে দিচ্ছি। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে, না বলে পারছি না। ১৯৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে যখন যমুনা নদীর ওপর সেতু করি তার আগে থেকেই আমাদের দাবি ছিল এখানে রেল সংযোগটা থাকতে হবে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেকেই আপত্তি করেছিল যে, এই রেল ভায়াবল হবে না। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এখন এতোই ভায়াবল সেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংকই আমাদের প্রস্তাব দিল যে, তারা যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু করে দেবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম, বাংলাদেশটা আমাদের আমরা জানি কি উন্নতি করতে হবে। ওই একজন দুইজন বাইরের থেকে এসে আমাদের ওপর খবরদারি, অনেকে পরামর্শ দেবে সেটা আর হবে না। আজকে তাদেরই অর্থে আমরা যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু করে দিচ্ছি।
 

কক্সবাজারবাসী উচ্ছ্বসিত নিজের নগরীতে ট্রেন চলাচলে।  

কক্সবাজারের চকোরিয়ার বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী আব্দুল করিম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আঁর ( আমার) দাদার মুখত (মুখে) তো শুনিতাম, রেললাইন আইবোঁ, এতদিন নআইয়ে( আসেনি)। এহন আঁরার(আমাদের) স্বপ্ন পূরণ হইব। ’

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য এই প্রকল্প যেন সোনায় সোহাগা। কক্সবাজারে ‘টং’ দোকানের ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আরারত্তুন বেজ্ঞল্লাত্তু সুবিধা থাকিউম। ’ 

কক্সবাজার সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান শরমিন সিদ্দিকা লিমা বলেন, কক্সবাজারের রেলসংযোগ তার মতো কর্মজীবীদের যোগাযোগ সহজ করেছে। অনেকেই জেলার বাইরে গেলে কীভাবে যাবে-একটা দুশ্চিন্তা ভর করতো।  

কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু ও ঈদগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, কক্সবাজারে আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠী রেল দেখবে ভাবেনি।

কক্সবাজারের এসব মানুষের সন্দেহভরা উচ্ছ্বাসের পিছনে রয়েছে  ১৩৩ বছরেও কক্সবাজার রেলপথ না আসার বাস্তবতা।  

১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। তারপর ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়।  

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুসারে কক্সবাজার পর্যন্ত বাদবাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি।

এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ স্থাপনে জন্য ২০১০ সালে প্রথম প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কথা ছিল।

পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ সমাপ্ত হলো।

মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।

প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে নয়টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।

তারপর চলতি বছরের আগস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারজন্য এ প্রকল্প আরও পিছিয়ে যায় কয়েক মাস।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত বন এলাকায় রেললাইন স্থাপন করায় বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর দৃশ্যমান আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ সত্যিই চোখ জুড়ানো বাস্তবতা।  

এরপরের চ্যালেঞ্জ মায়ানমারের আপত্তি নিষ্পত্তি করে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে রেলপথ চালু।  

এর ফলে বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজতর হয়ে উঠবে। কৃষি-খামার ও শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রফতানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসাধারণের কর্মচাঞ্চল্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২৩
এনবি/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।