ঢাকা, মঙ্গলবার, ৪ চৈত্র ১৪৩১, ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৭ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

উদ্বোধনের অপেক্ষায় যমুনা রেলসেতু

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫
উদ্বোধনের অপেক্ষায় যমুনা রেলসেতু

পাবনা (ঈশ্বরদী): দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান শেষে বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে একটি স্বপ্ন। পূরণ হতে চলেছে উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্ন ও দাবি।

দৃশ্যমান এখন দেশের বৃহত্তর রেলসেতু যমুনা সেতু।  

এখন শুধুই উদ্বোধনের অপেক্ষাই যমুনা নদীর ওপর নির্মিত যমুনা রেলসেতু।

এদিকে যমুনা রেলসেতুর উদ্বোধন ঘিরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।  

মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সকাল ১১টায় শান্তির প্রতীক পায়রা ও উদ্বোধনী বেলুন উড়িয়ে ১১টা ২০ মিনিটে ইব্রাহিমাবাদ রেলওয়ে স্টেশন থেকে সয়দাবাদ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত উদ্বোধনী স্পেশাল ট্রেন যমুনা সেতু দিয়ে ১২০ কিলোমিটার গতিতে পারাপার হবে। পরবর্তীতে স্পেশাল ট্রেনটি পুনরায় ফিরে আসবে।  

আর যমুনা রেলসেতু চালুর মধ্য দিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে। বিশেষ করে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটবে না। সহজেই বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করা যাবে। ফলে এ অঞ্চলে বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা উন্মোচন হবে।

মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টায় সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইলের মধ্যবর্তী যমুনা রেলসেতুর পূর্বপার ইব্রাহিমাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম।  

যমুনা রেলসেতুর উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম।  

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত মি. সাইদা শুনিচি ও জাইকার সাউথ এশিয়া ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল মি. ইতো তেরুয়ুকি। এছাড়া স্বাগত বক্তব্য দেবেন যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান।  

জাপানের নতুন প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ ও জাইকার যৌথ অর্থায়নে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা বিশেষ ধরনের স্টিলের পাটাতন দিয়ে যমুনার নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দেশের দীর্ঘতম রেলসেতু। এতে ব্যয় হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। দেশের রেলওয়েতে দৃশ্যমান উন্নয়নের দিক থেকে আরেক ধাপ এগোলো বাংলাদেশ।  

তবে সেতুতে ডাবল রেললাইন চালু হলেও সমস্যা সৃষ্টি করবে সেতুর পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের রেললাইন না থাকার কারণে। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১১৪ কিলোমিটার রেলপথ সিঙ্গেল থাকার কারণে ট্রেনে ক্রসিংয়ে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হবে এ অঞ্চলের মানুষের। রেল-কর্তৃপক্ষ বলছে, দ্রুতই প্রকল্পের মাধ্যমে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল রেললাইন প্রকল্পে চলমান রয়েছে। ডাবল লাইন নির্মিত হলে খুবই কম সময়ে ঢাকা আসা যাওয়া সম্ভব হবে।  

জাপানের নতুন প্রযুক্তিতে এই সেতুটি দেশের অন্য সেতুর থেকে অনন্য। এই সেতুতে রয়েছে ডাবল সমান্তরাল রেললাইন, দুইপাশে দুটি আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন, সেতুর ট্র্যাকের নিচে রয়েছে গ্যাস লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন। যা কিনা দেশের গোটা উত্তরাঞ্চলে বিশেষ ভূমিকা রাখে।  

জাপানের আইএইচআই, এসএমসিসি, ওয়ায়শি করপোরেশন, জেএপই এবং টিওএ করপোরেশন এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তিনটি প্যাকেজে ৫০টি পিলারের ওপর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওয়েদার স্টিলের ৪৯টি স্প্যানে পূর্ণরূপ পাওয়া ডাবল লাইনের রেললাইনে সেতু নির্মাণ করেন। প্রায় সাড়ে ৪ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা।  

তার আগে ডুয়েল ট্যাকের (ডাবল রেললাইন) যমুনা রেলসেতুতে ট্রায়াল রান শেষে একটি লেন দিয়ে গত মাসের ১২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল। আনুষ্ঠানিকভাবে আজ যাত্রা শুরু হলো।  


পাকশী বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো অ্যান্ড ক্যারেজ) আশীষ কুমার মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, যমুনা রেলসেতুতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পেশাল ট্রেন যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জ পশ্চিমপ্রান্ত সয়দাবাদ রেলস্টেশন পর্যন্ত চালানো হবে। ট্রেনের ছয়টি বগিতে সব রকম যান্ত্রিক পরীক্ষা- নিরীক্ষার পর প্রস্তুত করা হয়েছে।  

স্পেশাল ট্রেনে লোকোমোটিভ দুটি ইঞ্জিন সংযুক্ত করা হয়েছে। ইঞ্জিনসহ ট্রেনের চালক (এলএম) সহকারী চালক (এএলএম) মোট ৪ জন ট্রেনটি ইব্রাহিমাবাদ থেকে সয়দাবাদ স্টেশন পৌঁছাবে। ট্রেনের চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন চালক (লোকো মাস্টার) মনিরুজ্জামান ও শামসুর রহমান, সহকারী চালক (সহকারী লোকো মাস্টার) সাঈদ হাসান খান, ওসমান গনি ট্রেন চালাবেন।

পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ বীরবল মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায় ঈশ্বরদী-ঢাকা রুটে কোনো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে ঈশ্বরদী থেকে টাঙ্গাইল নিয়ে আসা সম্ভব হতো না, আমরা পূর্ব রেলওয়ের রিলিফ ট্রেনের ওপর নির্ভর ছিলাম। এখন অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অনায়াসে খুব তাড়াতাড়ি সহজেই রিলিফ ট্রেন আনা যাবে। তাছাড়া যমুনা বহুমুখী সেতুতে ট্রেন ওঠার আগে ট্রেনের বগিগুলো পরীক্ষা করার কারণে ১০ মিনিট দেরি হতো, এখন সেটা আর হবে না। আবার যমুনা সেতুর ওপরে কোনো ট্রেন থাকলে সিঙ্গেল লাইন থাকার কারণে পূর্বের স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে রাখা হতো। একটি পারাপার হওয়ার পর আরেকটি যেতো, এতে শিডিউল বিপর্যয় হতো, এখন সে সমস্যা রইল না।  

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক আসাদ বাংলানিউজকে জানান, যমুনা বহুমুখী সেতুর ৩০০ মিটার উজানে বাংলাদেশ ও জাইকার যৌথ অর্থায়নে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা বিশেষ ধরনের স্টিলের পাটাতন দিয়ে যমুনার নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতু। এর প্রতিটি স্প্যানের ওপর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে। ফলে দেশের দীর্ঘতম রেলসেতু দিয়ে মঙ্গলবার থেকে নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। যেটা দেশের যুগান্তকারী একটি অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। এর ফলে রেলওয়ে সেতুর ওপর দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। আগে ৪৪টি ট্রেন চলাচল করতো, আর এখন ৮৮টি ট্রেন চলাচলের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ট্রেন চলাচলের আন্তঃসংযোগ সৃষ্টি হবে। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মাণের কাজটি চলমান। যা শেষ হলে ট্রেনযাত্রীরা শতভাগ সুফল পাবেন।  

এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্ন ও দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে, যমুনা রেল সেতুতে ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে। ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলসেতু দেশের প্রথম ডাবল ট্র্যাকের ডুয়েলগেজ সেতু। নির্মিত সেতু কেবল প্রকৌশলগত বিষয় না, এই সেতু নির্মিত হওয়ার কারণে রেল যোগাযোগে, বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে দেশে নতুন দিগন্তের একটি দ্বার উন্মোচিত হলো। স্বল্প খরচে, কম সময়ে কিন্তু সড়কপথের চেয়ে ট্রেনে মালামাল আনা- নেওয়া সহজ। এতে দেশে রাজস্ব বাড়বে।  

যমুনা সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল-ফাত্তাহ মাসুদ আরও বলেন, আগে যমুনা বহুমুখী সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন পারাপার হতে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগত। কিন্তু এখন রেলওয়ের স্পিড অনুসারেই ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে, ফলে ব্রিজটি অতিক্রম করতে ৫ থেকে ৭ মিনিট সময় লাগবে। ভ্রমণপ্রিয় ট্রেনের যাত্রীদের কিছুটা স্বস্তি মিলবে।  

জানা যায়, ২০১৬ সালে প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন করা হয়। এতে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি করে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। যার মধ্যে ২৭.৬০ শতাংশ অর্থায়ন দেশীয় এবং ৭২.৪০ শতাংশ অর্থায়ন করেছে জাপানের জাইকা।

১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে যমুনা নদীর ওপর যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের পর সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে ফের পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পর রেলসেতু দিয়ে ব্রডগেজ-মিটারগেজের রেললাইন নির্মাণ হওয়ার পর সেতুর ওপর দিয়ে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ৪৪টি ট্রেন প্রতিদিনই চলাচল করার কারণে রেলসেতু ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফাটল ধরে। এসময় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন পারাপার হতো। এতে বিভিন্ন যাত্রীবাহী ট্রেনের বেশ শিডিউল বিপর্যয় হতো। ২০১৬ সালে আরেকটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। ২০২১ সালের মার্চে পিলার নির্মাণের পাইলিং কাজ শুরু হয়। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর ' বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুটির নাম পরিবর্তন করে 'যমুনা রেলসেতু' নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।