ঢাকা: বুধবার (২৬ মার্চ) মহান স্বাধীনতা দিবস।  বাঙালি জাতির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

স্বাধীন বাংলাদেশ এবার ৫৫ বছরে পা দিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ ১৯০ বছরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর নতুন করে জেঁকে বসে জান্তা। ভারতকে বিভক্ত করে পাকিস্তান নামের যে আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয় পূর্ব বাংলা থেকে ছিল তার হাজার মাইলের ভৌগোলিক বিছিন্নতা। শুধু তাই নয় ভাষা, সংস্কৃতির কোনো মিল ছিল না বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের। এ সত্ত্বেও পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। বাঙালির ওপর চেপে বসা এ রাষ্ট্রটির যাত্রার শুরুতেই পূর্ব বাংলার মানুষ সীমাহীন অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সব দিক থেকে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের স্বীকার হয়। বঞ্চিত হতে থাকে ন্যায্য অধিকার থেকে। তবে এ পরিস্থিতিকে তখন থেকেই মেনে নেয়নি এ ভূখণ্ডের মানুষ। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমুলক আচরণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদে নামে, আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। দ্রুতই এ আন্দোলন সংগ্রামগুলো একত্রিত হয়ে জাতীয় সংগ্রামে রূপ নিতে থাকে যা স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হয় এবং ৭১ এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

পাকিস্তানের দুঃশাসন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি শুরু থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নামে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে বাঙালি ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তোলে। মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সংগ্রামের পথ প্রশস্ত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনসহ দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে এসে উপনীত হয়। পাকিস্তানের সামরিক, স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির এ সব ধারাবাহিক আন্দোলন এক পর্যায়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। বাঙালির এ আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হলেও বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে। ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক প্রহসনে পরিণত হয়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে যায়।

২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। অপারেশন সার্চ লাইট নামে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ওই রাতেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা এবং রাজারবাগে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক, বাঙালি পুলিশ ও সামরিক সদস্যদের হত্যা করতে থাকে। নিরীহ মানুষকে হত্যা, আগুন দিয়ে বাড়ি ঘর, জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করে ‘মাটি চাই, মানুষ চাই না’ এ নির্দেশ বাস্তবায়ন শুরু করে তাদের সামরিক বাহিনী।

২৬ মার্চ থেকেই ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, চাকরিজীবী, নারী, পুরুষ, বাংলার সর্বস্তরের সব শ্রেণি পেশার মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্বরভাবে যে গণহত্যা শুরু করে। তারা সারা বাংলাদেশে সে ঘৃণ্য কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আলশামস বাহিনীও গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এর বিরুদ্ধে অসীম সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে বীর বাঙালি। অদম্য সাহস আর মনোবল নিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে যার অবস্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যায়।  দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কাছে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন এ মহান স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে উদযাপন হচ্ছে।

সোমবার (২৪ মার্চ) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে প্রত্যুষে একত্রিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বিদেশি কূটনীতিকরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এছাড়াও জেলা ও উপজেলার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন জাতীয় সংগীত পরিবেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে।

দিবসটিতে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরে সহজে দৃশ্যমান ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হবে। তবে এদিন সরকারি ছুটি।  

বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৫
এসকে/আরআইএস