ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

পরমাণুশক্তি ছাড়া গতি নেই

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬
 পরমাণুশক্তি ছাড়া গতি নেই অধ্যাপক ড. শান্তনু চক্রবর্তী, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

২২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর  সায়েন্স ল্যাবর‍টরিতে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) এর আয়োজনে ইঞ্জিনিয়ারিং মেটেরিয়াল অ্যান্ড মেট্যালারজিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক  তিন দিনব্যাপী প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন ভারতের জাতীয় গবেষণা একাডেমির (টাটা) সাবেক অধ্যাপক ড. শান্তনু চক্রবর্তী।

ঢাকা: ২২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর  সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) এর আয়োজনে ইঞ্জিনিয়ারিং মেটেরিয়াল অ্যান্ড মেট্যালারজিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক  তিন দিনব্যাপী প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন ভারতের জাতীয় গবেষণা একাডেমির (টাটা) সাবেক অধ্যাপক ড. শান্তনু চক্রবর্তী।

বাংলানিউজের পক্ষ থেকে অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।

অধ্যাপক শান্তনু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশনও  করেন। তারপর ইংল্যান্ডে বৃত্তি নিয়ে  এনার্জি কনভারশন অ্যান্ড এনভারমেন্ট বিষয়েও পড়াশুনা করেন। পিএইচডি করেন বেসিক ব্যাকগ্রাউন্ড অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ।

দেশে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চেষ্টা করেও বিভিন্ন আইনি জটিলতায় তা হয়ে ওঠেনি বলে জানান। এরপর ৫ বছর বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পর ১৯৮৯ সালে টাটা স্টিলে যোগ দেন। ২২ বছর টাটা কোম্পানির বিভিন্ন এরিয়াতে কাজ করে ২০১১ সালে অবসর নেন। এরপর টাটার বিভিন্ন প্রশিক্ষণে ও খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত আছেন।

নিচে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত:

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ কেন এমন একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের ব্যাবস্থা করেছে?

অধ্যাপক শান্তুনু চক্রবর্তী: বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সাইন্টিফিক এন্ড ইনডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) প্রথমবারের মত এ সম্মেলনটির আয়োজন করেছে। উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতায় কোন সন্দেহ নেই। যে থিমটা এবারের কনফারেন্সে বেছে নেওয়া হয়েছে সেটা যথাযথ । থিমটা সম্পর্কে আমি উচ্ছসিত এ কারণে যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এমন একটা  থিমকে চয়েস করা পটেনসিয়ালি স্ট্রং বলে মনে করি।

বাংলানিউজ: থিমটা একটু বুঝিয়ে বলবেন

অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তী: ‍থিমটা হচ্ছে Materials for Energy, Environment, and Health। অর্থাৎ শক্তি  এবং পরিবেশ সম্পর্কিত নানা মেটেরিয়ালের দিক নিয়ে আলোচনা। সব জায়গাতে মানুষ পরিবেশটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাতে করে আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছাব সেখানে মেটারিয়ালের সঙ্গে পরিবেশটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাবে।

টেকনোলজিতে ২০৩৫ সালে ভারতের ‍অবস্থা কী হবে ভারত সরকার তার দূরদর্শী একটা ভিশন-২০৩৫ তৈরি করেছে। আমি নিজে এ কর্মপরিকল্পনার একটা ‍অংশে টেকনিক্যাল এডিটর  ছিলাম। বিশেষ করে মেটেরিয়ালসে।   এ ভিশনের মধ্যে মেটাল এবং মেটেরিয়ালকে ধরা হয়েছে যেমন: অ্যালুমিনিয়াম, কপার, জিংক, নিকেল, লেড, স্টিল-আয়রন প্রভৃতি। মাইনিং নিয়ে কথা হয়েছে। আরো এসেছে বায়োমেটেরিয়াল, ইলেকট্রনিক মেটেরিয়াল, এনার্জি মেটেরিয়াল, কমপোজিট, গ্লাস এবং সিরামিক এসকল নিয়ে কথা হয়েছে।  

ঘটনাচক্রে আমার চিন্তার সঙ্গে এ সম্মেলনের শিক্ষক, ছাত্র বিশেষজ্ঞদের চিন্তা একই সূতায় গাঁথা ছিল। এটি ভীষণভাবে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি হচ্ছে, ২০৩৫ সালে এ অঞ্চলের জিডিপি কী হবে, লোকসংখ্যা কী হবে, শিক্ষার লেবেল কী হবে, ফার্টিলিটি রেট কী হবে কেউ বলতে পারছে না। কিন্তু একটা ট্রেন্ড আছে; সেটা থেকে এবং সারা বিশ্বের গবেষণার যে স্থিতাবস্থা বা স্থানাঙ্ক সেগুলোকে বিচার করে মোটামুটি একটা আন্দাজ করা যায়। গেস আর এস্টিমেট আজকাল যাকে ‘গেস্টিমেট’ও বলা হচ্ছে।

আমরা এমন  একটা জায়গায় পৌঁছাতে চাই সেটাই হল ভিশন। সাধারণ সমাজে বলুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বলুন, গবেষণাগারে বলুন, সংসারে বলুন, কিছু লোক থাকে যারা খুব নেগেটিভ। তারা সবসময় বলবে, এটা কখনই হবে না। আবার কেউ অবাস্তবের পিছনে ছোটে। এ দুটিকে ব্যালেন্স করে নিয়ে ভারত সরকার শুধু মেটারিয়ালস নয়: লেদার, সিরামিক, টেক্সটাইল, এডুকেশন, হেলথকেয়ার, এনভারয়নমেন্ট, আবাসন, পানি এরকম প্রায় বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চিন্তা করছে। এ নিয়ে ১২টা ডকুমেন্ট তৈরি হচ্ছে। একটা মাস্টার ডকুমেন্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বছর আগে রিলিজ করেছেন। তার রোডম্যাপগুলো ধীরে ধীরে বেরুচ্ছে।

মেটাল মেটেরিয়াল বেরিয়েছে জুলা‌ই এ,  ম্যানুফ্যাকচার বেরিয়েছে সেম্টেম্বরে। আমি এ দুটি মূল বই এর কপি, যা পাবলিকলি পাওয়া যায় না, তা বিসিএসআইআর কাছে দিয়ে গেলাম। এটা দেখলেই ভারতের ভিশনের ছাপটা পাওয়া যাবে।

বাংলানিউজ: মেটাল আমাদের জীবনযাত্রা কীভাবে প্রভাবিত করে?

অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তী: একটি ছোট্ট ‌উদাহরণ দিই। লেড যাকে আমরা সীসা বলি। প্রচুর কাজে লেগেছে। এ নিয়ে কিন্তু পুরো বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরে যাচ্ছে। কারণ এটা পরিবেশবান্ধব নয়। কারণ বিষাক্ত ধাতু। সুতরাং সীসাকে হটাতে হবে। কিন্তু সীসা হটিয়ে আমরা বাঁচতে পারব না। ব্যাটারিতে যে সীসা ব্যবহার করা হয়, নানানভাবে তার প্রয়োগ বেড়ে যাচ্ছে। তবে ১৫ বছর আগে সীসার ব্যবহার ২২ টা জায়গায় ছিল। এখন তা কমে এসে তিনটা জায়গায় দাঁড়িয়েছে। তার ৮২ শতাংশ এখন শুধু ব্যাটারিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা বাড়তেই থাকবে। ব্যাটারিতে বাড়লেও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবশ্য সীসার ব্যবহার এখন কমে আসছে। যেমন, রং-এ যে সীসা ব্যবহার করা হত তা কমে এসেছে। স্টিল কোটিং-এ সীসার প্রলেপ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সারা পৃথিবী থেকে সচেতনতার জন্যই এটা হচ্ছে। পেট্রোলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ২০৩৫ সালের ভিশনে বিষয়টি কিভাবে দেখা হবে তা এ সম্মেলনে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
শক্তি ও পরিবেশ এরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ কীভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে?

অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তী: ৫ বছর পর বাংলাদেশে গাড়ি তৈরির কারখানা হবে না কে বলতে পারে! দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পথপদর্শক। কারণ বাংলাদেশে অ্যাডভান্সড ইনফরমেশন ওয়ার্নিং সিস্টেমগুলো অনেক শক্তিশালী হয়েছে। সেভাবে যদি নতুনভাবে একটা প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তা হলে মেটেরিয়াল সিলেকশনে এনভায়রনমেন্টে কনসিডেরাশনের দিকটায় আমরা কীভাবে এগুতে পারি তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ কারণেই এ ধরনের কনফারেন্স খুবই কাজে আসবে।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তী:  বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ ৪০ বছরের নীচে। এ মানুষদের জাগ্রত করতে হবে। ভারত ভিশন-২০৩৫ নিয়ে যেভাবে কাজ করছে বাংলাদেশও এমনটা করতে পারে। যদি সরকারের পক্ষে আদৌ এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয়েছে। এর সম্পদ আহরণে কী করা যেতে পারে?

অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তী:  বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও সমুদ্রতলদেশে প্রচুর পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, ক্রোমিয়াম বলতে গেলে অবব্যহৃত অবস্থায় অলস পড়ে রয়েছে। সারা দুনিয়ায় স্থলভাগের তিনশ গুণ বেশি পরিমাণ ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে সমুদ্রে। এখন থেকে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে অদূর ভবিষ্যতে যখন ভাঁড়ারে টান পড়বে তখন আমরা তা কাজে লাগাব। টেকনলোজি নিয়ে যদি আমরা রেডি থাকতে পারি।

বাংলাদেশ যে একলক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা পেয়েছে এবং তাতে যে লক্ষ কোটি টন সম্পদ রয়েছে তা এখন তোলা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও তার সমীক্ষা করে রাখা উচিত।

এ পদার্থ সালফাইট ফর্মে না অক্সাইড ফর্মে রয়েছে, মেকানিজম অব লিফটিং, ম্যাকানিজম অব সর্টিং আউট, মেকানিজম অব ব্রেকিং ডাউন, মেকানিজম অব কনভারসন---এসব কাজ যদি ঠিকমত এখন থেকেই বাংলাদেশ সবার সহযোগিতা নিয়ে করতে পারে, তবে তা হবে এক দুর্দান্ত যুগান্তকারী কাজ। যে কাজটা এখন ভারত করছে। বাংলাদেশের সমুদ্রে কতটুকু গ্যাস আছে তারও সার্ভে দরকার।

বাংলানিউজ: ২০২০ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হতে গেলে এনার্জি খাতে কী ধরনের রূপান্তর দরকার?

অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তী: পরিবেশবান্ধব জ্বালানির সমস্যা বাংলাদেশের মত ভারতেরও রয়েছে। যে মুহূর্তে জ্বালানি ব্যবহার হবে সে মুহূর্তে পরিবেশের ক্ষতিও কিছুটা হবে। সুতরাং সেই ক্ষতিটাকে কী ভাবে সামাল দেব? এ নিয়ে আগে থেকেই ভাবতে হবে, পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। এখন অনেক ছাড়পত্র নেওয়ার পরেই প্ল্যান্ট বসাতে দেওয়া হয়।   আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা ছাড়া কোনো গতি নেই। এজন্য আমাদের ‍যতটা সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সবচেয়ে বিপজ্জনক শক্তির আধার হল পারমাণবিক শক্তি। কিন্তু তার পরেও এই শক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬
কেজেড/জেএম/

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।