ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

হায়! এ কোন বাংলাদেশ!!

আদনান সৈয়দ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫
হায়! এ কোন বাংলাদেশ!!

গত তিন সপ্তাহ যাবত প্রতিদিনই খবরের কাগজে পুড়ে যাওয়া মানুষের বিভৎস ছবি ছাপা হচ্ছে। ইদানিং মনে হয় খবরের কাগজ মানেই যেন এক বিভীষিকা আর আতংকের আর্তনাদ! বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে খুব কাঁপা কাঁপা হাতে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর পাতা ব্রাউজ করি।

তারপর খুব ভয়ে ভয়ে সব ভয়ংকর সংবাদগুলো পড়তে শুরু করি। তখন মানসপটে কিছু দৃশ্য অবচেতনভাবেই একটি একটি করে ভেসে আসতে শুরু করে। স্পষ্ট দেখতে পাই হাজার জনতার মাঝে কিছু মুখচ্ছবি।

যাদের চোখে ছিল স্বপ্ন, যাদের হৃদয়ে ছিল ভালোবাসায় বোনা সুখের ঠিকানা অথচ আজ তারা খবরের কাগজের প্রথম পাতার সংবাদ। তাদের কারো শরীর পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে, কেউ আগুনে দগ্ধ হতে হতে মৃত্যুর প্রতি নিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, ককটেলের আঘাতে কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো বুক বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, কেউ রাজপথে নিজের রক্তের উপর লুটিয়ে পড়ে আছেন। নাহ! খুব বেশিক্ষণ আর কাগজের পাতায় এ ছবি দেখা যায় না, এই ভয়ংকর খবর পড়া যায় না। অথচ খুব ভালো করে জানি, এই ছবিগুলো সিনেমার শুটিং থেকে নেওয়া কোনো দৃশ্য নয়, কল্পনায় আঁকা কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড় নয়। কয়লা হয়ে যাওয়া এই প্রতিটা ছবি বাস্তব, প্রতিটা চরিত্র সত্য। যে লোকটি এই কিছুক্ষণ আগেও বাসে চড়ে ছিলেন অনাগত ভবিষ্যতকে আগলে ধরে সেই লোকটির এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। তাকে দেখলে চেনা যায় না। মনে হয় পুড়ে যাওয়া কোনো এক ধ্বংস্তূপের মাঝে আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি। মনে হয় আদিম বর্বরতার কোনো এক সময়ের সাথে আমরা আমাদের বসত গড়েছি। এ কোন সভ্যতা?

আমি থাকি বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। দেশের জন্যে প্রাণটা শুধুই কাঁদে। সেই দূর থেকে এই বিভৎস সংবাদগুলো পড়া ছাড়া আমার মতো প্রবাসীর আর কি করার আছে? কি করতে পারি? অথচ আমি খুব ভালো করেই জানি আমরা যারা প্রবাসে থাকি আমরা কিন্তু আমাদের ফেলে আশা দেশটাকে বুকে নিয়ে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি আবার সেই দেশটাকে বুকে নিয়েই আবার ঘুমোতে যাই। লাল সবুজের পাতাকাটা বুকের মাঝে নিত্য পত পত করে উড়ছে বলেই আমাদের প্রবাস জীবনের সমস্ত কঠিন বাস্তবতাও অবলিলায় খুব সহজ হয়ে যায়। আমরা স্বপ্ন দেখি। সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন। কারণ স্বপ্ন আছে বলেই আমরা এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু এ আমার কোন স্বদেশ?

৭১ সালে আমরা বাঙালিরা পাকিস্তানী হায়নাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি দেশের জন্ম দিয়েছিলাম। অথচ আজ স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পর আমরা এ কোন দৃশ্য দেখছি? আজ আমরা এক বাঙালি আরেক বাঙালি ভাইয়ের গায়ে আগুন ঢেলে দিচ্ছি? একজন জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারছি? এর জন্যই কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম? ত্রিশ কোটি শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই কি আমাদের দেখার কথা ছিল? দু লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের সামনে আমরা কোন সাহসে দাঁড়াবো?  আমরা আর কতো নোংরা হবো? আর কতো বাংলাদেশকে অপমান করবো?

খুব ভয়ে থাকি। আমরা যারা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে থাকি তাদের ছোট্ট বুকে প্রতিনিয়ত একটা ভয় নিত্য কুরে কুরে খায়। খুব স্বার্থপরের মতোই আমরা আমাদের বাংলাদেশে ফেলে আসা প্রিয় মানুষগুলোর কথা ভাবি। আমাদের বৃদ্ধা মা-বাবা, সন্তান, স্ত্রী, ভাই-বোন,বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার চেহারা তখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। তারা প্রতিদিন বাসে কিংবা সিএনজিতে কিংবা ট্রেনে কিংবা নিজের গাড়িতে অফিসে যাচ্ছেন, স্কুলে যাচ্ছেন। আল্লাহ না করুন তাদের যদি কিছু হয়ে যায়? এসব ভেবেটেবে একজন প্রবাসীর এখন দিন কাটে, রাত কাটে। প্রতিনিয়ত এক ধরনের আতংক আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। রাতে ঘুম হয় না। বাংলাদেশ থেকে অপিরিচিত একটা কল এলেই বুকের ভেতর যেন দ্রিম করে ওঠে। একদিকে প্রবাস জীবনের কঠিন বাস্তবতা অন্যদিকে দেশের জন্যে ভাবনা।   এ কোন দোজখের মধ্যে আমাদের বসবাস? এর শেষ কোথায়? ভাবতেই পারি না এই বিংশ শতাব্দীতে একজন জীবন্ত মা ও তার শিশু চোখের সামনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছেন! আমি ভাবতে পারি না রাস্তায় খোলা মাঠে এক যুবক পাখির মতো ডানা ঝাপটিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। কালো পিচের রাস্তা নিমিষেই লাল হয়ে যাচ্ছে! না, আমার সমস্ত বিবেক, মানবতাবাদী চিন্তা কোথায় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। তাহলে কি আমার ভাবনার শক্তিগুলো দিন দিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে? এ কোন মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছে আমার স্বদেশ?

যে মানুষটি চোখের সামনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছেন তিনিতো আমার ভাই, আমার মা, আমার বাবা, বোন। আমরা কাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছি? আমরা ভাইকে? আমার বাবাকে? আমার বোনকে? যারা এই হীন কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন তারা কি একটিবার এই প্রশ্নটা নিজেকে করেছেন? কার স্বার্থে এই বর্বরতম কাজটি আমরা করছি? যে মায়ের সন্তান আজ পুড়ে কয়লা হয়ে গেলো তার বুকের হাহাকার কি কেউ শুনতে পায় না? যে টগবগে যুবকের বুকটা নিমিষেই ঝাঁঝরা হয়ে গেল সেতো আমারই ভাই? যে শিশুটির একটি পা ককটেলে উড়ে গেল তার দোষ কী? এ কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা? আমরা কি একে আদৌ রাজনীতি বলতে পারি? রাজনীতি সবসময়ই দেশের মঙ্গলের জন্যে, দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে পেট্রল বোমা ফেলে, বিভিন্ন স্থানে গুপ্ত হামলা ঘটিয়ে সে অধিকার কি পূরণ হতে পারে? হওয়া সম্ভব?

বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা সবসময় আশাবাদী। বাঙালি পৃথিবীর অন্যতম সাহসী এক জাতি। অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রই ধোপে টেকেনি। টিকতে পারে না। বাঙালি শান্তিপ্রিয় জাতি। তবে তারা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। বাংলাদেশ নামের দেশটা বানের জলে ভেসে আসেনি। এই দেশটাকে অর্জন করতে আমাদের এক সাগর রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। সেই রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। তাই আমি বিশ্বাস করি বর্তমানে বাংলাদেশে যে কঠিন ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার একটা সুন্দর সমাধান হবেই হবে। বাংলাদেশে অনেক মেধাবী মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক, সুশীল সমাজভুক্তরা রয়েছেন। তাদের প্রতি জোর দাবি— ‘দয়া করে সবাই এগিয়ে আসুন। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে বাঁচান’।

আমরা একটা মানুষকেও আগুনে পুরে মারা যেতে দেবো না। এ দেশ আমার। আমাদের সকলের। সবাই মিলে সুন্দর একটা বাংলাদেশ গড়বো এটা আমাদের শুধু স্বপ্ন নয়, আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।