ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ঝুমুর নাচ এবং উপেক্ষিত চা শ্রমিকদের ভাষা ও সংস্কৃতি

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৫
ঝুমুর নাচ এবং উপেক্ষিত চা শ্রমিকদের ভাষা ও সংস্কৃতি

ঢাকা: এক দিকে মাদল বাজছে আরেক দিকে গান গেয়ে বিশেষ ছন্দে একটি দল নাচছে। কখনও দ্রুত লয়ে বা  কখনও ধীর লয়ে।

আবার একটি বেদীকে কেন্দ্র করে দলটি তালে তালে ঘুরছে। এমন অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর নাচের নাম ঝুমুর নাচ। মূলত ঝুমুর গান প্রাচীন ধারার লোকসঙ্গীত। অনেক কাল আগে বিশেষ করে সাঁওতালদের মাঝে এটির প্রচলন ছিল। প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন জনপদেও এ নাচের কথা উল্লেখ রয়েছে। সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে ঝুমুরের সঙ্গে কীর্তন মিশে পরবর্তীকালে যাত্রার উদ্ভব ঘটেছে।

চা বাগানে বসবাসরত চা শ্রমিকেরা প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এদেশে আসে। তখনই সাথে করে ঝুমুর নাচের অনন্য সংস্কৃতি নিয়ে আসে তারা। চা শ্রমিকদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল নাচ। এরমধ্যে ঝুমুর নাচ, সাঁওতাল নাচ ও লাঠি নাচ অন্যতম। এসব নাচ কোন বিনোদনের জন্য আয়োজন করা হয় না। সাধারণত এসব নাচ বিভিন্ন পূজাকে উপলক্ষ্য করে হয়ে থাকে। ঝুমুর নাচও হয় করম পূজাকে উপলক্ষ্য করে। চা বাগানে বসবাসরত শ্রমিকেরা সম্পদ রক্ষার জন্য উপাসনার উদ্দেশ্যে এই পূজা করে থাকে। ঝুমুর নাচ ও গান একই সাথে হয়। নিজস্ব সম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে ভাদ্র মাসের একাদশীর সাত দিন আগে থেকে ঝুমুর নাচ ও গানের মহড়া শুরু হয়। বংশ পরম্পরায় এই সংস্কৃতির তারা লালন ও চর্চা করে আসছে।

ঝুমুর নাচ প্রকৃত পক্ষে প্রার্থনা নির্ভর। সৃষ্টিকর্তার করুণা লাভই এর প্রধান লক্ষ্য। নাচ, গান ও বাদ্য সহযোগে ঝুমুর গাওয়া হলেও এতে গানের প্রাধান্য থাকে।   বাদ্যযন্ত্রের মাঝে মাদল, ঢোল ও করতাল ব্যাবহার করা হয়। গানের সুর উচু থেকে নিচে অবরোহণ করা হয়, যা ঝুমুরের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তালকে অগ্রাহ্য করে মাত্রা অনুসরণ করে সুর দেওয়া হয়। সম থেকে শুরু না করে ফাঁক থেকে গান শুরু করা হয়। ঝুমুর গানের কথা গুলো ভিন্ন হলেও সুরের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় না। ঝুমুর গানের কথা গুলো বাস্তবধর্মী এবং আসামীয় ভাষার প্রভাবযুক্ত। চা শ্রমিকদের দৈনন্দিন সুখ দুঃখ নিয়েই গান গুলো রচনা হয়। তবে মজার ব্যাপার হল এই গান গুলো কোথাও লিখে রাখা হয় না। মুখে মুখেই গানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। ঝুমুর নাচ দলগত ভাবে পরিবেশন করা হয়। চা বাগানের নারী ও পুরুষেরা একত্রে শৃঙ্খলিত ভাবে পরিবেশন করে। এ সময় একটি পবিত্র বেদীকে কেন্দ্র করে নাচের দল বৃত্তাকারে নেচে গেয়ে ঘুরে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল এই নাচ কাউকে হাতে ধরে শেখাতে হয় না বরং বংশগত ভাবেই এই নাচ চা শ্রমিকেরা ধারন করে। অপূর্ব সুরলহরী সহকারে সমবেত ছন্দে শৃঙ্খলিত নৃত্যের ঝুমুর নাচ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে পারে।     

ঝুমুর নাচ সাধারণত বাড়ির আঙিনায় সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। ভাদ্র মাসের একাদশীতে প্রায় সকল চা বাগানেই ঘটা করে ঝুমুর নাচের আয়োজন হয়। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে চা শ্রমিকেরা এই নাচ দেখতে ভিড় জমায়। চা শ্রমিকদের শ্রমনির্ভর সাদাকালো জীবনে কিঞ্চিৎ বিনোদনের খোরাক যোগায় ঝুমুর নাচ।

এতো গেল শুধু ঝুমুর নাচের কথা। এ রকম আরও অনেক সংস্কৃতি চা শ্রমিকেরা যুগের পর যুগ বংশ পরম্পরায় লালন করছে। উচ্চশ্রমে নিম্ন মজুরি পেলেও আদিপুরুষের এসব সংস্কৃতি চা শ্রমিকেরা নীরবে নিভৃতে যুগের পর যুগ চর্চা করছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে চা বাগান গুলোতে প্রায় ৯৮টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। যার মাঝে হাতে গোণা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশই সরকারি গেজেটের বাইরে। এই সকল জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রনে চা বাগানগুলো সমৃদ্ধ।

অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর পৃথক ভাষা, রীতিনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সব রয়েছে। অনেক ভাষার লিখিত রূপ রয়েছে। কতগুলো ভাষার লিখিত রূপ আগেই হারিয়ে গেছে। আর অনেক ভাষা যথাযথ সংরক্ষনের অভাবে হারিয়ে যাবার পথে। চা বাগান গুলোতে সার্বজনীন যোগাযোগের জন্য বর্তমানে আসামীয়-বাংলা-নাগরি সংমিশ্রণে যে ভাষা প্রচলিত আছে সেটাকে স্থানীয়ভাবে বাগানী ভাষা বা জংলী ভাষা বলা হয়। এ ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই। চা বাগানে শিক্ষায় এত পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ ভাষাগত দুর্বলতা।

নিজস্ব মাতৃভাষা ব্যতিরেকে বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ তাদের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। ফলে মূলধারার সাথে তারা প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না।

মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ মানবাধিকার; এটি শিশু অধিকারের একটি বিষয়। শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা, মেধা বিকাশ এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শিশুর বিকাশ পরবর্তী সময়ে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে সহায়তা করে। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে (২০১০) ক্ষুদ্র জাতিগুলোর জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের কথা বলা আছে। ইতিমধ্যেই সরকার কয়েকটি ক্ষুদ্রজাতির জন্য প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে যাচ্ছে। কিন্তু চা বাগানে উল্লিখিত ৯৮টি জাতিগোষ্ঠীর একটিও এই তালিকায় নেই। ফলে চা শ্রমিক সন্তানেরা মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। যদিও সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ (খ)-এ সমাজের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথভাবে সব নাগরিকের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরব হচ্ছে সব মাতৃভাষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। এমনই মর্যাদা দেয়া হয়েছে নেপালের নতুন সংবিধানে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা নেপালিকে রাষ্ট্র বা জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেনি। তারা লিখেছে, অল দ্য মাদার টাংস স্পোকেন ইন নেপাল শ্যাল বি দ্য ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ। ‘নেপালে উচ্চারিত সকল মাতৃভাষা জাতীয় ভাষা হিসেবে গণ্য হবে। ’  এই বহু ভাষাভাষী ও জাতির জনগোষ্ঠীকে কী করে মূলধারার সাথে একত্র করা যায়, তার সযত্ন  চেষ্টা তাদের সংবিধানে ফুটে উঠেছে। কিন্তু চা শ্রমিকেরা বহুকাল ধরেই ভাষাগত বৈষম্যের শিকার। সংবিধানের ২৩ (ক) ধারা বলছে ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং  ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ’ কিন্তু চা শ্রমিকদের সংস্কৃতি রক্ষায় নেই কোন সরকারি উদ্যোগ। যেখানে শুধু সংস্কৃতি রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়; এই সংস্কৃতি উন্নয়ন ও বিকাশেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেখানে বাস্তবতা ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে চা শ্রমিকেরা এই দেশে আসে। যুগের পর  যুগ তারা এই ভূমিতেই নিজস্ব শ্রম মেধা বিলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার এতো বছর পরেও চা শ্রমিকেরা উপেক্ষিত। রাষ্ট্র চা শ্রমিকদের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন। ব্রিটিশ আমল থেকে এপর্যন্ত চা শ্রমিকদের জীবনমানের কোন উন্নয়ন হয়নি বরং ভূমি দখল, মজুরি বৈষম্য ইত্যাদি কারণে তাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলা হয়েছে।

যেকোনো ভাষা বা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট জাতির তরফ থেকে সচেতন উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু এখানে এ দুটোরই অভাব আছে। কোনো জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের যে সঞ্চিত জ্ঞান তা ধারণ করে ভাষা ও সংস্কৃতি। কাজেই ভাষা বা সংস্কৃতি যখন হারিয়ে যায় তখন জ্ঞানের সেই ভাণ্ডারও হারিয়ে যায়। কাজেই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি। অচিরেই চা শ্রমিকদের সংস্কৃতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।
 
তাদের জন্য একটি ‘সাংস্কৃতিক একডেমী’ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেখানে চা বাগানে বসবাসরত ৯৮টি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির মুক্ত চর্চা হবে। চা শ্রমিকের সন্তানেরা তাদের নিজ নিজ জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্কে জানতে পারবে। যেখানে চা শ্রমিকদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নিত্য নতুন গবেষণা হবে। যার ফলে আর কখনও চা শ্রমিকদের ভাষা ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়বে না। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আরও বর্ণিলভাবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৫
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।