ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বন্ধু আবদুল্লাহ আল ফারুক

মাহমুদ হাফিজ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
বন্ধু আবদুল্লাহ আল ফারুক আবদুল্লাহ আল ফারুক

আবদুল্লাহ আল ফারুককে নিয়ে এই লেখাটি না লিখলে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না। কারণ, তার সঙ্গে আমার স্মৃতি তরতাজা, আন্তরিক ও দীর্ঘ বন্ধুত্বের নিবিড়তায় গাঁথা।



শনিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরেই তার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো জাতীয় প্রেসক্লাবে। দুপুর ঠিক দুইটায় যখন প্রেসক্লাবের ডাইনিং লাউঞ্জে ঢুকি, ফারুক তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক আমিরুল মোমেনিনসহ কয়েকজনের সঙ্গে খাবার খাচ্ছিলেন। চোখাচোখিতেই কুশল বিনিময় হলো। তার সঙ্গে কিছু আলাপ থাকার কথা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে আমি টেবিলের খালি আসনটিতে বসার ইচ্ছেয় বেসিনে হাত ধুতে গেলাম। ততোক্ষণে পাশের টেবিলে প্রেসক্লাবকর্মী সেলিম দুপুরের খাবার পরিবেশন করে সেখানে বসার অনুরোধ করতে লাগলেন।

খেতে শুরু করতেই এ টেবিলে এসে বসলেন সাংবাদিক ফারুক কাজী, গাফফার মাহমুদ ও আলিমুজ্জামান হারুন। খাওয়ার মধ্যে প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী এসে একটি ব্যক্তিগত কথা ফিসফিসিয়ে আমাকে বললেন। পাশের টেবিলে ফারুককেও কিছু একটা বললেন।

দুপুরে খাওয়ার পর সাংবাদিকরা সাধারণত টিভি লাউঞ্জে বসেন এবং চা কফি খাওয়াসহ খোশগল্প করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ফারুক খাওয়া শেষ করে টিভি লাউঞ্জের দিকে যেতে যেতে সেদিকে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। এর মানে হচ্ছে, ‘ওদিকে আসুন, আলাপ আছে’।

এ সময় অনুজপ্রতিম সাংবাদিক মনজুর এ আজিজের ফোন এলো। তিনি এ এলাকায় থাকায় প্রেসক্লাবে দেখা করতে এসেছেন। আজিজ প্রেসক্লাবের সদস্য নন, ওয়েটিং লাউঞ্জের সোফায় অপেক্ষা করছেন। খাওয়া শেষ করে টিভি লাউঞ্জের ভেতর দিয়ে আজিজের সঙ্গে দেখা করতে সেদিকে পা বাড়ালাম। এ সময় ফারুককে খুব মনোযোগী হয়ে টিভি দেখতে দেখলাম। ইঙ্গিতে বোঝালাম, ‘গেস্ট বিদায় করে আসছি’।

ভাবলাম, আজিজের সঙ্গে আলাপ সেরে এসে ফারুকের সঙ্গে আড্ডায় বসবো। কতোদিন, গত কয়েক সপ্তাহ তার সঙ্গে দেখা হয় না। শুনেছি, তিনি এখন কঠিন সময় পার করছেন। এ সময় খোঁজ-খবর নেওয়াই বন্ধুর কাজ।

কিন্তু ওয়েটিং লাউঞ্জে বসার মধ্যেই দেখি ফারুক কাচের দরজা ঠেলে বের হয়ে যাচ্ছেন। হাত উঁচু করে উচ্চস্বরে বললাম, ‘ফারুক, আপনার সঙ্গে আলাপ আছে। আলাপ না সেরেই চললেন যে!’

তিনি আনমনে খানিকটা দাঁড়ালেন। বললেন, ‘যাই ভাই, পরে আলাপ হবে’।

তাকে খুব বিক্ষিপ্ত মনে হলো। তিনি প্রেসক্লাবের সদর দরজা দিয়ে মেইন গেটের দিকে পা বাড়ালেন। কি কারণে জানি না, মেইন গেট পার না হওয়া  পর্যন্ত আমি তার দিকেই তাকিয়ে রইলাম।

এ সময় আজিজকে বললাম, ‘ওনাকে চেনেন তো? কালের কণ্ঠের চিফ রিপোর্টার ছিলেন’। আজিজ বললেন, ‘এখন কালের কণ্ঠে উনি নেই’।

ইতোমধ্যে দৈনিক ভোরের ডাকের বার্তা সম্পাদক মাহবুব আলম এসে পাশের সোফায় বসেছেন। তিনি যোগ করলেন, ‘ফারুক কালের কণ্ঠে এখন আর নেই’।

আবদুল্লাহ আল ফারুক ছিলেন আপাদমস্তক রিপোর্টার। রিপোর্টার হিসাবে সব সময় তিনি সফলতার সাক্ষর রেখে গেছেন। যেসব কাগজে তিনি কাজ করেছেন, আবদুল্লাহ ফারুকের লিড আইটেম কিংবা রিপোর্ট ছাড়া সেসব কাগজ বেরিয়েছে কি-না সন্দেহ! তার আচার-আচরণে গ্রাম্য সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করতো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘরানার সাংবাদিক ফারুক ভরজীবন বিএনপি বিটে কাজ করে গেছেন। যিনি যে মতে বিশ্বস্ত, বস্তুনিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য তাকে উল্টোস্রোতে কাজ করতে দেওয়া হয় সাংবাদিকতায়।

ফারুক ভরজীবন ছিলেন উল্টোস্রোতের বিশ্বস্ত সাংবাদিক। কাজ দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন তিনি দলান্ধ নন, পেশাদার রিপোর্টার।

আবদুল্লাহ আল ফারুকের সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বই সালের দিকে। ভোরের ডাক পত্রিকা যখন নয়াটোলা থেকে বের হতো, তখন সেখানে রিপোর্টার হিসাবে কাজ করতেন তিনি। সহপাঠি বন্ধু সরকার নাসিম (কানাডাপ্রবাসী) সেখানকার বড় দায়িত্বে থাকায় সে অফিসে আমার যাতায়াত ছিল। সে সুবাদে ফারুকের সঙ্গে দেখা ও সখ্য। এ বন্ধুত্ব ও পেশাদারি সহমর্মিতা বিস্তৃত হয়েছে তার সংবাদ, যুগান্তর ও কালের কণ্ঠ জীবনে।

নব্বইয়ের দশকজুড়ে উত্তাল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল, ধর্মঘটময় দিনগুলোতে আমরা একসঙ্গে ফিল্ড রিপোর্টিং করেছি। একের খামতি আলাপচারিতায় দূর করেছি আরেক।

আবদুল্লাহ আল ফারুকের সঙ্গে আমার যে আলাপ, সে আলাপ না সেরেই তিনি চলে গেলেন। এ আলাপ কিসের আলাপ? বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর এ আলাপ বোধ করি জন্ম-জন্মান্তরের। পেশাদারিত্ব, বৈষয়িকতার বাইরে নিবিড় বন্ধুত্বের। সে আলাপে থাকে আবেগ-অভিমান কিংবা নিতান্ত নিরর্থক হৃদ্যতার উষ্ণতা।

কিন্তু ফারুক সে আলাপ না সেরেই আমাকে বা আমাদের এক আত্ম হাহাকারের মধ্যে ফেলে আকস্মিক চলে গেলেন। গেলেন তো গেলেন-সারা জীবনের জন্য গেলেন। বন্ধুকে আলাপের আর কোনো সুযোগই দিলেন না! 

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এএসআর

** সাংবাদিক ফারুকের মৃত্যুতে ডিআরইউ’র ৩ দিনের কর্মসূচি
** সাংবাদিক ফারুকের দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন
** সাংবাদিক ফারুকের মৃত্যুতে খালেদার শোক
** প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ফারুকের জানাজা সম্পন্ন
** ডিআরইউ প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ফারুকের জানাজা দুপ‍ুরে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।